অসময়ে ডেঙ্গুর হানা, আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ৫ গুণ বেশি
2023.06.09
ঢাকা
চলতি বছর মৌসুমের আগেই বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সরকার, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে। অস্বাভাবিকভাবে এ বছর ইতোমধ্যে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২১ জন।
জুলাই থেকে অক্টোবরকে ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে থাকলেও শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২১ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৮৬৫ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকায় দুই হাজার ১২৮ জন, বাকিরা ঢাকার বাইরে।
চলতি বছরের জুন মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত যখন দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ৮৬৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ২১ তখন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের ৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫১০ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল শূন্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিস বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপ-প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোঃ একরামুল হক সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, “অনেক বিজ্ঞানী এ বছর সম্ভাব্য বড় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। আমাদেরও একই রকম আশঙ্কা আছে।
এদিকে গত ২৯ মে, এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুরোগী পাঁচগুণ বেশি।
বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের অধিদপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান করে দেখা গেছে, ২০২২ সালে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যু হলেও সে বছর জুন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ ১৭৯ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সে বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৯টি মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল এবং তৃতীয়-সর্বোচ্চ ২০২১ সালে ১০৫টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু সে বছরও জুনের মধ্যে কোনও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
জলবায়ু পরিবর্তন: ডেঙ্গুর অনুকূল আবহাওয়া!
অসময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ডেঙ্গুর জন্য একটি 'অনুকূল' আবহাওয়া তৈরি হওয়ার পাশাপাশি অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও নানারকম সংকট পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে এবং সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার শঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নির্মাণাধীন জায়গা, পানির সংকটের কারণে পানি সংগ্রহ করে রাখাই ডেঙ্গুর সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাবের প্রধান কারণ হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ কবিরুল বাশার মনে করেন, জুন পর্যন্ত আক্রান্তের যে হার তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
বেনারের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, এই অস্বাভাবিক আক্রান্তের ঘটনা এটাই প্রমাণ করছে যে, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন উৎসের সক্রিয়তা ব্যাপক।
এই সময়েও কেন ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বাইরেও তিনটি বিষয় চিহ্নিত করছেন কবিরুল বাশার।
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, শহরের বড়ো বড়ো বিল্ডিংগুলোর বেজমেন্টে গাড়ি পরিষ্কারের পর জমে থাকা পানি, বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের জমে থাকা পানি এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা বাড়িতে মানুষ পানি ধরে রাখছে এমন পাত্র থেকেও এডিস মশা প্রজনন ঘটাচ্ছে।
“সম্ভাব্য প্রাদুর্ভাব রোধে সচেতনতা বাড়ানো এবং জনগণকে সতর্ক করার পাশাপাশি এডিস মশার প্রজনন উৎস ধ্বংস করার কোনো বিকল্প নেই,” বলেন কবিরুল।
রোগতত্ত্ববিদ এ এম জাকির হোসেন বেনারকে বলেন, এডিস মশা দৃশ্যত বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণত ১৬ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বংশবৃদ্ধি করার কথা থাকলেও এখন বছরের উষ্ণতম সময়ে বংশবৃদ্ধি করছে এডিস মশা।
এটিকে উদ্বেগজনক লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “গত বছর থেকে চারটি ডেঙ্গু সেরোটাইপ সক্রিয় ছিল যেখানে আগে মাত্র দুটি সেরোটাইপ পাওয়া যেত। একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত ব্যক্তি পরবর্তীতে অন্য সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।”
ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকায় বরাবরই অভিযোগ ওঠে সিটি কর্পোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা কিন্তু বসে নেই। মশার প্রজনন ক্ষেত্র নির্মূলে যেমন কাজ করছি একই ভাবে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে।”
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও এ বছর প্রচুর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আমরা সেখানেই বেশী মনোযোগ দিচ্ছি।”
প্রকোপ বেড়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এ বছর এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরের তুলনায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের রিফিউজি হেল্থ ইউনিটের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা মোঃ রিজুয়ানুল হক ভূঁইঞা বেনারকে বলেন, গত ২৭ মে পর্যন্ত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোট এক হাজার ১৬৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
তিনি জানান, এ বছর অন্তত দুই রোহিঙ্গা শরণার্থী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৯ জন শরণার্থী।
আবু তোহা বলেন, একটি মশা অন্তত ছয়জন মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। সেই বিবেচনায় শরণার্থী শিবিরগুলো খুবই স্পর্শকাতর।
“তবুও আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,” বলেন আবু তোহা।