এশিয়ায় বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা, বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের আশঙ্কা
2023.08.07
গতমাসে ছেলেকে সাথে নিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীকে দেখতে ঢাকায় এসেছিলেন শাহিনুর বেগম। কিন্তু রাজধানীতে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই পড়েছেন নতুন স্বাস্থ্য সংকটে।
জ্বর ও রক্ত বমিতে প্রায় নির্জীব হয়ে পড়ায় এবার ছেলে সাব্বিরকে (১৪) মেডিকেলে নিতে হয়েছে।
“ডাক্তাররা নিশ্চিত করেছে সাব্বির ডেঙ্গুতে আক্রান্ত,” বেনারকে বলেছেন তার চাচি হালিমা বেগম।
“মেয়েটার অবস্থা ভাবেন! এক হাসপাতালে তার স্বামী, আরেক হাসপাতালে ছেলের জীবন নিয়ে টানাটানি,” গত মাসে সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালের বিছানায় সাব্বিরের পাশে বসে বলছিলেন তিনি।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১৪ জন মারা গেছেন। ফলে এ বছর মোট মৃতের সংখ্যা ৩২৭ এ দাঁড়িয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে প্রায় ২৮০০ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছর এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মশা বাহিত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যা এ যাবত কালের সর্বোচ্চ বার্ষিক রেকর্ড।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেছেন, চিকিৎসক, হাসপাতালের শয্যা ও লজিস্টিক সংকটের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
“ঢাকায় ঘরে ঘরে জ্বরে আক্রান্ত রোগী দেখতে পাবেন,” বেনারকে বলেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গত মাসে বলেছে, বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু সংক্রমণ হতে পারে। এমন লক্ষণের মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে অনেক দেশে ডেঙ্গু বাড়ছে।
সংস্থাটি বলছে, এ বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ৫৬,৭২১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ১৪৪.৭ শতাংশ বেশি।
গত বছর এই সময় পর্যন্ত দেশটিতে ২৩,১৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। ২০২২ সালের তুলনায় বছরের প্রথমার্ধে মৃত্যু দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এ বছর সেখানে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩৯ জন।
এ বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত থাইল্যান্ডের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ৪৬,৮৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী রেকর্ড করেছে। প্রাণহানি হয়েছে ৪১ জনের। ২০২০ সালের পর দেশটিতে এটাই ডেঙ্গু বিস্তারের সর্বোচ্চ মাত্রা। ২০২২ সালে সারা বছরে সেখানে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৬,৫৪২।
কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কায়ও সংক্রমণ বেড়েছে।
সিঙ্গাপুরের ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের সংক্রামক রোগের অধ্যাপক ওওই ইং ইয়ং বলেছেন, “আগের তুলনায় বৃদ্ধির কারণ অনিশ্চিত।”
“এটি সম্ভবত ভাইরাসটির গঠন পরিবর্তনের কারণে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি এ বছরের এল নিনোর আবহাওয়ার ঘটনাসহ অন্যান্য অনেক কারণ হতে পারে,” বলেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ডেঙ্গু বিশ্বের দ্রুততম ছড়ানো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ, যা এডিস মশার কামড়ে ছড়ায়।
নগরায়ন মশা প্রজননের আবাসস্থল তৈরি করে এবং বিস্তৃততর বৈশ্বিক গতিশীলতা তাদের ভৌগলিক পরিসরকে প্রসারিত করে। একে রোগ বিস্তারের দীর্ঘমেয়াদী কারণ মনে করা হয়। প্রাদুর্ভাব তীব্র হওয়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেও বিভিন্ন গবেষণায় দায়ী করা হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তাপমাত্রার কারণে মশার মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাসের নতুন সংস্করণ তৈরি, প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কামড়ানোর হার, সংক্রমণ ঋতুকালের সম্প্রসারণকে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এল নিনোকে এই বছরের বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না। তবে এর কারণে এশিয়ায় সৃষ্ট উষ্ণ তাপমাত্রা সংক্রমণে একই রকম স্বল্পমেয়াদী প্রভাব ফেলে।
হাসপাতালে গাদাগাদি অবস্থা
বাংলাদেশের বর্তমান প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থল ঢাকায় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা মারাত্মক চাপের মধ্যে রয়েছে। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সরকার দুটি হাসপাতালকে শুধু ডেঙ্গুর জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। সারাদেশের সমস্ত মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালকে ডেঙ্গু ওয়ার্ড খোলার আহ্বান জানিয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক সৈয়দা ফাহমিমা মোমো বলছিলেন, “আমরা রোগীদের চিকিৎসা করতে হিমশিম খাচ্ছি।”
“বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলায় কয়েকটি ডেঙ্গু ওয়ার্ডের দায়িত্বে আমি একাই আছি। এটা সামলানো আসলেই কঠিন,” বেনারকে বলেন তিনি।
ডেঙ্গুর চারটি ধরনের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গহীন বা হালকা উপসর্গ, কিছু লোক উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং সামান্য রক্তক্ষরণ অনুভব করতে পারে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে মূলত রোগীদের ব্যথা নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরে যাতে পানিস্বল্পতা তৈরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়।
এখন পর্যন্ত, কয়েকটি দেশে মাত্র দুটি ভ্যাকসিন লাইসেন্স করা হয়েছে - যার মধ্যে একটি শুধুমাত্রে তাদের জন্য প্রযোজ্য যাদের অতীতে একবার সংক্রমণ হয়েছে।
এছাড়া মশাদের শরীরে ওলবাচিয়া নামক একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত করে দিয়ে রোগটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি ইতিবাচক ফল দিচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড মসকুইটো প্রোগ্রামের এই পদ্ধতিতে দেখা গেছে, ব্যাকটেরিয়াটি মশার শরীরে ভাইরাসের প্রতিলিপি হওয়া বন্ধ করে।
তবে এশিয়ায় বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে কীটনাশক দিয়ে মশক নিধন, বাড়ির চারপাশে জলের পাত্রের মতো মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো দূর করার জন্য সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করা হয়।
বিশ্ব মশা প্রোগ্রামের ফিল্ড এনটোমোলজির পরিচালক পিটার রায়ান বলেছেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কাছে যে সরঞ্জাম আছে স্পষ্টতই তা দিয়ে ডেঙ্গুর এই উদীয়মান শহুরে সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ১৯৫০ এর দশক থেকে আমরা ডেঙ্গুর ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখেছি।”
“আমরা গত দুই থেকে তিন দশক ধরে বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া হ্রাসের দুর্দান্ত সাফল্য দেখেছি; কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে অবস্থা বিপরীত।”
ডেঙ্গুর প্রকোপ শুধু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলেই নয়, ইউরোপের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি উদ্ধৃতি বিশ্বে প্রতি বছর ৩৯ কোটি ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের ইঙ্গিতবহ যার মধ্যে ৯ কোটি ৫০ লাখ ঘটনা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায়। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার পূর্বাভাস আছে।
বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ৭০ শতাংশ ঘটনা এশিয়ায় এবং ঢাকা বা জাকার্তার মতো বিস্তৃত, দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলো এডিস মশার জন্য আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্র।
রায়ান বলেন, সর্বাধিক সংক্রমিত দেশগুলোতে, শিশু, কিশোর এবং নারীরা যারা সাধারণত প্রাথমিক পরিচর্যাকারীর ভূমিকা নেয়, তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে দরিদ্রতম গোষ্ঠীগুলো সাধারণত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, “যদি এই বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ শীর্ষে চলে যায়, অবস্থা অনুযায়ী আগামী ৩-৪ অথবা ৫-৭ বছর পর এটি সম্ভবত আরো বাড়বে।”
“তাই আমাদের খেলায় এগিয়ে থাকার পরিকল্পনা করতে হবে। ভ্যাকসিন, ওলবাচিয়া এর মতো সরঞ্জাম রয়েছে ... এবং আমরা যত বেশি এই জিনিসগুলোকে জনস্বাস্থ্যের সাথে যুক্ত করব, আমরা ডেঙ্গুর সাথে বাঁচতে ততই প্রস্তুত হব,” বলেন তিনি।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।