ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামলাতে বিদেশ থেকে স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত

আহম্মদ ফয়েজ
2023.09.20
ঢাকা
ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামলাতে বিদেশ থেকে স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্ত ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতালে স্যালাইন গাঁথা অবস্থায় এক শিশুকে নিয়ে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে হাঁটছেন এক অভিভাবক। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
[এপি]

বাংলাদেশে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত স্যালাইন সরবরাহ করতে না পারায় বিদেশ থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

দরপত্র ছাড়াই ভারত থেকে ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ লাখ ব্যাগ স্যালাইন কেনার প্রস্তাবে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই প্রস্তাব দেন।

অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্ব এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান।

গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) এসব স্যালাইন আমদানি করবে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি ভিত্তিতে ইডিসিএল ২০ লাখ পিস (নরমাল স্যালাইন এক হাজার মিলিলিটার এবং গ্লোকোজ স্যালাইন এক হাজার মিলিলিটার) আইভি ফ্লুইড কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

গত ৮ আগস্ট স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সাত লাখ পিস স্যালাইন কেনার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে তিন লাখ পিস স্যালাইন কেনা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত ‘ইতিবাচক’

স্যালাইন আমদানির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি।

সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে মাত্রায় পৌঁছেছে তাতে এর কোনো বিকল্প ছিল বলে আমাদের মনে হয় না। তাই বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।”

দেশে প্রতিদিন এই স্যালাইনের চাহিদা কত সে সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা কারো কাছে নেই দাবি করে তিনি বলেন, “দেশে স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতা প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫৩ লাখ ব্যাগ। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিতে এই সংখ্যক স্যালাইন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”

“স্বাভাবিক সময়ে এই স্যালাইনের খুচরা মূল্য ৯০ থেকে ১০০ টাকা থাকে। বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন দাম কোথাও কোথাও ৫০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মানুষ নিরুপায় হয়ে কিনছে,” বলেন তিনি।

জাকির হোসেন বলেন, “চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় বাজারে ঠিক মতো স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।”

এদিকে সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে বুধবার এক প্রতিবেদনে দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানায়, স্বাভাবিক অবস্থায় বাংলাদেশে প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা ছিল। ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে মাসিক সেই চাহিদা দুই কোটি ব্যাগ ছাড়িয়ে গেছে।

তিন বছর ধরে সরকারিভাবে উৎপাদন বন্ধ

দেশে স্যালাইনের চরম সংকট থাকলেও গত তিন বছর ধরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) প্ল্যান্টে স্যালাইন উৎপাদন তিন বছর ধরে বন্ধ।

স্বাস্থ্য অধিকারকর্মীদের ভাষ্য, আইপিএইচ প্ল্যান্টটি চালু থাকলে স্যালাইন সংকট অনেকাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো। সেই সঙ্গে দামও কম রাখা যেত।

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফয়েজুল হাকিম লালা বেনারকে বলেন, “কয়েক বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রাখার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ধরে অকার্যকর। আইপিএইচ কর্তৃপক্ষ এবং ওষুধ প্রস্তুতকারকদের মধ্যে একটি অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলেই জনগণকে এই সংকটে পড়তে হচ্ছে।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বেনারকে বলেন, “আইপিএইচ উৎপাদনে থাকলে প্রতিদিন ১২ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন সম্ভব হতো। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ থাকায় একদিকে নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দীন বেনারকে বলেন, “উৎপাদন মানসম্মত নয় এমন অভিযোগে ২০২০ সালে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর স্যালাইন ইউনিট বন্ধ করে দেয়।”

“এই ইউনিটটি আবারো কীভাবে সচল করা যায় তা নিয়ে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ,” যোগ করেন নাসির।

সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড

চলতি বছর ডেঙ্গু শনাক্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে বুধবার সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আবারো ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত আরও ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে ৮৬৭ জনের জনের মৃত্যু হলো।

একই সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে তিন হাজার ১৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

গত বছর দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। যা ওই বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক ছিল। এর আগে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে সাত জন ও ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।