ডেঙ্গু: দুই লাখ ছাড়িয়েছে হাসপাতালে ভর্তি, মারা গেছেন প্রায় এক হাজার

আহম্মদ ফয়েজ
2023.09.29
ঢাকা
ডেঙ্গু: দুই লাখ ছাড়িয়েছে হাসপাতালে ভর্তি, মারা গেছেন প্রায় এক হাজার রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক ডেঙ্গু রোগীকে স্যালাইন গেঁথে দিচ্ছেন একজন নার্স। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। গত ২২ বছরে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের কাছাকাছি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা পর্যন্ত ডেঙ্গু শনাক্তের পরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ৯৮১ জন। এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৭৫ জন।

বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য রাখতে শুরু করে।

২০২২ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে দেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট দুই লাখ ৪৪ হাজার ২৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী। এই ২২ বছরে মোট ৮৪৯ জন মারা গেছেন।

শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ বুলেটিনে দেখা গেছে, চলতি বছর ৮২ হাজার ৪১৭ জন ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং বাকি রোগীরা ঢাকার বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

ডেঙ্গুতে ৬৩১ জন মারা গেছেন ঢাকায়।

প্রকৃত রোগীর সংখ্যা ৫ গুণ বেশি

সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের মত, আনুষ্ঠানিকভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর যে সংখ্যা পাওয়া যায়; প্রকৃত রোগীর সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের পরিচালক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন বেনারকে বলেন, “এটা নিয়ে আমাদের সরাসরি কোনো জরিপ নেই, তবে বিভিন্ন হাসপাতালে যে টেস্টগুলো হয় তা বিশ্লেষণ করে এমন একটি ধারণা পেয়েছি যে, প্রকৃত রোগীর সংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি হবে।”

তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন যে বুলেটিন প্রকাশ করা হয় তা মূলত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা। এই তালিকা থেকে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা জানা সম্ভব নয় বলেই অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নেয়া হয়।

খোঁজ-খবর করে আমরা যে অবস্থা জানতে পেরেছি তা হলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী বাসা-বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেগুলো আমাদের তথ্যভাণ্ডারে আসছে না। তাই আমরা মনে করছি, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি,” বলেন তিনি।

তবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হিসাব সঠিক বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা। আগামী বছর থেকে টেস্টের তথ্যও সংগ্রহ করবে অধিদপ্তর বলেও জানান তিনি। 

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে গত মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেছেন, “রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল রোগী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তারা আর পারছে না। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও সিট নেই। প্রাইভেট ক্লিনিকে খুব খারাপ অবস্থায় রোগী গেলে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।”

ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ, তথ্য সংগ্রহ, নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে দাবি করে সানিয়া বলেন, “ঢাকাসহ সারা দেশে হাজার হাজার হাসপাতালের মধ্যে ৬৩টি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য নেওয়া হয়। সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যু অনেক বেশি।”

সানিয়ার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।

তিনি বেনারকে বলেন, “নানা কারণেই আমাদের দেশে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে প্রতিফলিত হয় না। যদিও সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রোগের প্রকৃত অবস্থাটা জানা জরুরি।”

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “সরকারের বিভিন্ন বিভাগে এখনো সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।”

সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে জানতে চাইলে গত সপ্তাহে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, “সাধারণ মানুষের সচেতনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন, সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের সর্বাত্মক কার্যক্রমের ফলে আগামী এক মাসের মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।”

সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছে দাবি করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন এলাকায় সকাল-বিকেল নিয়মিত মশক নিধন স্প্রে করা হচ্ছে।”

ডেঙ্গুকে গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “শুধু বাংলাদেশই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে না, এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশ এই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করছে।”

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলার পেছনে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ববিদ ড. এ. এম জাকির হোসেন বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো আরও তীব্র হয়, যা ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে।”

তিনি বলেন, “মশা আবহাওয়ার ওপর বিশেষভাবে সংবেদনশীল, কারণ এর শরীরের তাপমাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে যে আবহাওয়া বিরাজ করছে, তাতে এটি মশার জন্য খুবই ইতিবাচক একটি সময়। উচ্চ তাপমাত্রা মশার প্রজনন ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, ফলে ডিম ফোটে এবং লার্ভার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে স্বাভাবিকের তুলনায় সময় কম নেয়।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন যখন হয় তখন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তন ঘটে। এডিস মশাসহ অন্যান্য মশার প্রজনন বৃদ্ধির জন্য উপযোগী তাপমাত্রা পায়।

দেশে বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপের পেছনে তাই স্পষ্টতই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব বড়ো নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে,” বলেন তিনি।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বেনারকে বলেন, “ডেঙ্গু এক সময় ঢাকাসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে দেখা গেলেও এবার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। তাপমাত্রা মশার জীবনচক্র এবং আচরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা মশার বংশ বৃদ্ধি এবং রোগ সংক্রমণের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা প্রায় শূন্য দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা মশার আবাসস্থল বিস্তারে অবদান রেখেছে। ফলে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকিও বেড়েছে।”

রোহিঙ্গা শিবিরে আক্রান্ত ১২ হাজার, ১৪ জনের মৃত্যু

গত ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৩৪০ জনে দাঁড়িয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু তোহা মো. রিজুয়ানুল হক ভূঁইঞা বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, “কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পের মধ্যে উখিয়ার চারটি ক্যাম্পে পুরোনো খাল ও জলাশয়ের কারণে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি।”

সংক্রমণ কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী তৎপর রয়েছে বলেও জানান তিনি। 

ডেঙ্গু টিকার সফল গবেষণা

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু রোগের টিকার গবেষণা সফল হয়েছে।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আইসিডিডিআর,বি ও যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএম) লার্নার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষকরা জানিয়েছেন, এই টিকা ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪; চারটি ধরনের বিরুদ্ধেই কার্যকর।

এতে বলা হয়, এক ডোজের ডেঙ্গু টিকা টিভি-০০৫ মূল্যায়ন করে দেখা যায়, এটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের ওপর প্রয়োগ নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।

বুধবার ডেঙ্গু টিকার এই সফল পরীক্ষা নিয়ে আন্তর্জাতিক সাময়িকী ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। টিকার নাম দেওয়া হয়েছে টিভি-০০৫ (টেট্রাভেলেন্ট)।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।