থানা ও আদালত হয়ে বাসায় ফিরলেন ‘নিখোঁজ’ ইসলামি বক্তা আবু ত্বহা ও সঙ্গীরা
2021.06.18
ঢাকা
আট দিন ‘নিখোঁজ’ থাকার পর ফিরে এসে থানা ও আদালত হয়ে শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বাসায় পৌঁছেছেন ইসলামি বক্তা আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান। তাঁর সাথে নিখোঁজ বাকি তিনজনেরও খোঁজ মিলেছে একই দিন।
পুলিশের মতে ত্বহা নিজেই লুকিয়েছিলেন। তবে ফিরে আসার পর তাঁকে ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ দেখাচ্ছিল বলে জানিয়েছে পরিবার।
ত্বহা শুক্রবার বিকাল তিনটার দিকে রংপুর শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় তাঁর শ্বশুর বাড়িতে ফিরে আসেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন তাঁর শ্যালক মো. জাকারিয়া।
ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরই দুই সহযোগী ও গাড়ি চালকসহ ত্বহাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁদের পাঠানো হয় আদালতে।
রংপুর মেট্রোপলিটন জুডিশিয়াল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করার পর চারজনকে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানায় পুলিশ।
খোঁজ পাওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার মো: আবু মারুফ হোসেন বলেন, আবু ত্বহা ও তাঁর তিন সহযোগী “নিজেদের ইচ্ছায়” গাইবান্ধায় তাঁর এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কারণেই তাঁরা লুকিয়েছিলেন। তবে এই লুকিয়ে থাকার পিছনে “কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না।”
তবে তাঁরা কী কারণে লুকিয়েছিলেন তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
এ ঘটনায় পুলিশ কোনো মামলা করেনি জানিয়ে মারুফ হোসেন বেনারকে বলেন, “উনার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে আমরা তাঁদের আদালতে পাঠাই। আদালতে জবানবন্দি নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেন।”
বিকেলে ত্বহা বাসায় ফেরার পর সাংবাদিকেরা তাঁর সাথে কথা বলার আগেই পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে আসে বলে জানান পরিবার সদস্যরা।
ত্বহার শ্বশুর বাড়িতে তাঁর এক ভাই মোহাম্মদ তারেক সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা তার সঙ্গে কথা বলার সময় পাইনি। সে আসল। তাকে ভাত খাওয়ানোর সুযোগও পাইনি। ওসি সাহেব এসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেলো।”
“সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত,” বলেন মোহাম্মদ তারেক।
বেনারের পক্ষ থেকে ত্বহার স্ত্রী সাবিকুন্নাহারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “উনি ফিরে এসেছেন। এখন এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”
ত্বহা যখন রংপুর ফিরে আসেন তখন নাহার ঢাকায় অবস্থান করছিলেন বলে বেনারকে জানান শ্যালক মো. জাকারিয়া।
তিনি বলেন, গত ১০ জুন বৃহস্পতিবার রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন ত্বহা, তাঁর দুই সহযোগী এবং গাড়িচালক। ওই দিন দিবাগত রাত আড়াইটার পর ঢাকার গাবতলি থেকে তাঁকে বহনকারী গাড়িটি নিখোঁজ হয়।
নিখোঁজ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ত্বহা তাঁর স্ত্রী নাহারকে জানান, তাঁর গাড়ি ঢাকার গাবতলি পৌঁছেছে। এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে এক সপ্তা চারজনের আর কোনো খোঁজ পাচ্ছিল না তাঁর পরিবার।
দুদিন আগে তাঁর স্বামীকে একজন নিরীহ মানুষ আখ্যা দিয়ে তাঁকে খুঁজে বের করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আবেদন জানান নাহার।
আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনান অনলাইনে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে একটি ইউটিউব চ্যানেলে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। তিনি রংপুরে বসবাস করেন। ইসলামি ব্যাখ্যার কারণে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয়।
গুমের কয়েকটি ঘটনা
বাংলাদেশে এর আগে আকস্মিকভাবে অনেকেরই গুমের শিকার হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এদের কাউকে পরবর্তীতে মৃত হিসাবে পাওয়া গেছে, কাউকে কাউকে পরবর্তীতে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কেউ কেউ কিছুদিন পর ফিরে এলেও এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। আবার অনেককেই গুম হবার পর একেবারেই পাওয়া যায়নি।
পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন থেকে গুমের পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযুক্ত করলেও বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা গুম-নিখোঁজের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।
২০১২ সালের এপ্রিলে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ও সাবেক সাংসদ ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার আলী। এখনও তাঁদের খোঁজ মেলেনি।
২০১৪ সালের এপ্রিলে নিখোঁজ হন পরিবেশবাদী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ব্যবসায়ী স্বামী আবু বক্র সিদ্দিক। প্রায় ৩৫ ঘণ্টা পর ঢাকার কলাবাগান এলাকায় তাঁকে পাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিখোঁজ হয়ে ৪৬৭ দিন পর বাসায় ফিরে আসেন ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান।
এ ছাড়া কবি ফরহাদ মজহার, আলোকচিত্রশিল্পী শহীদুল আলম, ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, সাংবাদিক উৎপল দাসসহ গত কয়েকবছরে বেশ কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নাগরিক নিখোঁজ হয়ে ফিরে এসেছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে ২০২১ সালে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন ৬১১ জন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৫৮৭ জন গুম হয়েছেন, যাদের ১৪৯ জন এখনও নিখোঁজ।
এ বছর প্রথম চার মাসে ১১ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে অধিকার।
পুলিশের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়
মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটনের মতে, ত্বহার ফিরে আসার ব্যাপারে “পুলিশ যা বলছে সেটি কোনো স্বাভাবিক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।”
তিনি বেনারকে বলেন, “উনার স্ত্রী বলেছেন, আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনানের সাথে সর্বশেষ যখন কথা হয় তখন তিনি ঢাকার গাবতলিতে ছিলেন। এরপর উনি আবার গাইবান্ধা চলে গেলেন! উনি যদি গাইবান্ধায় লুকিয়ে থাকবেন তাহলে উনি ঢাকা পর্যন্ত আসবেন কেন?”
“উনার স্ত্রী মানবাধিকার কর্মীদের জানান, আবু ত্বহা মুহাম্মদ আদনানকে বগুড়া থেকে দুটি মোটরসাইকেল অনুসরণ করে আসছিল। তিনি বিষয়টি লক্ষ করে ফোনে তাঁর স্ত্রীকে বিষয়টি জানান,” বলেন নূর খান।
ত্বহা “বাসায় ফেরার পর পরই পুলিশ গিয়ে আটক করে তাঁকে এবং তাঁর তিন সহযোগীকে থানায় নিয়ে আসে,” জানিয়ে নূর খান বলেন, “পুরো ঘটনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সাধারণ মানুষ মনে করে এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। যে কারণে গত আটদিন পুলিশ তাঁকে উদ্ধারের ব্যাপারে তেমন কোন কিছু জানায়নি।”
তিনি বলেন, “এর আগে আমরা দেখেছি, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান এক বছর নিখোঁজ থাকার পর বাসায় ফিরে এলেন। বেরিয়ে তিনি কোনো কিছু বলেননি। চুপ হয়ে গেছেন।”
“আমি আশা রাখি পুলিশ দেশের মানুষকে বোকা ভেবে এই ধরনের আষাঢ়ে গল্প বলা থেকে বিরত থাকবে,” বলেন নূর খান।