বাংলাদেশে বিদেশি নারীর মৃত্যুদণ্ড রহিত করার দাবি সাত মানবাধিকার সংগঠনের
2024.06.07
ঢাকা
মাদক মামলায় এক বিদেশি নাগরিককে দেয়া মৃত্যুদণ্ড রহিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশি-বিদেশি সাতটি মানবাধিকার সংস্থা।
বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইডিএইচ) এক বিবৃতিতে বাংলাদেশেকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের আইনগত সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০২২ সালে প্রায় তিন কেজি হেরোইন রাখার অপরাধে আটক হয়েছিলেন আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানার তরুণী লেসেডি মোলাপিসি (৩০)।
ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় গত ২৭ মে ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আমিনুল ইসলাম মোলাপিসিকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
মৃত্যুদণ্ড বিষয়ক গবেষক ও বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বেনারকে বলেন, “মাদক মামলায় কোনো বিদেশি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম না, তবে একজন নারীর ক্ষেত্রে খুবই বিরল। আগেও বিভিন্ন সময় বিদেশি কিছু নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তবে কার্যকর ঘটনা আছে বলে আমাদের জানা নেই।”
এর আগে ১৯৯৩ সালে এক মাদক মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এলিয়েদা মেকর্ডের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে মার্কিন দূতাবাস তাঁকে ছাড়িয়ে নেয়।
সাজা কমানোর দাবি
এফআইডিএইচ ছাড়াও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অ্যান্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রোজেক্ট, ডিটশোয়ানেলো—দ্য বতসোয়ানা সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস, এলিওস জাস্টিস—মোনাশ ইউনিভার্সিটি ও অধিকার মোলাপিসির সাজা কমানো দাবি জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় সরকার ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ও ৪০২ ধারা এবং সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অধীনে কমিয়ে দিতে পারে।
“প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, আমরা অবিলম্বে মোলাপিসির সাজা কমানোর জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, কারণ একটি অহিংস অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ডের স্পষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন করে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
এতে আরও বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (আইসিসিপিআর) অংশীদার হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য ‘জেনে-বুঝে খুনের মতো গুরুতর অপরাধেও যেখানে মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার বিষয় রয়েছে’, সেখানে মাদক মামলায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকাই বাঞ্ছনীয়।
আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড অনুসারে, মাদক সংক্রান্ত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার জাতিসংঘের ড্রাগ কনভেনশনের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন—উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “এই নিষ্ঠুর শাস্তির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি না হওয়া পর্যন্ত এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহার করতে আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করছি।”
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংযুক্ত করে।
মৃত্যুদণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন
সাতটি সংগঠনের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত বছর বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩৯০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচটি রায় কার্যকর করা হয়েছিল। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১১১টি মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে দেশের বিভিন্ন আদালত।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলেছে, এখানে বিচারের দুর্বল মানদণ্ডের মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা ও কার্যকর করা হয়।
ন্যায্য বিচারের অধিকার লঙ্ঘন করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নির্বিচারে হত্যার শামিল হিসেবেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে।
বাংলাদেশের কারা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে আড়াই হাজারে বেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি রয়েছেন; যাদের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে।
এসব আসামিদের আট বাই আট ফুটের একটি ঘরে রাখা হয়; ভেতরেই একটি বাথরুম রয়েছে। এই বন্দিরা ঘরের বাইরে যেতে পারেন না।
উল্লেখ্য, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হলেই কনডেম সেলে পাঠিয়ে দেওয়ার বিধান গত মাসে বেআইনি ঘোষণা করে হাইকোর্ট। ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিচারিক কার্যক্রম পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগে তাঁকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে ওই রায় স্থগিত হয়।
শিশির মনির বলেন, “পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মৃত্যুদণ্ড থেকে বেরিয়ে এলেও আমাদের দেশে নতুন নতুন আইনে মৃত্যুদণ্ড রাখা হচ্ছে, এটি খুবই উদ্বেগের ব্যাপার।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে তদন্ত সংক্রান্ত ভুল প্রায়ই ঘটে। ফলে কোনো অবস্থাতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা উচিত নয়। কারণ এটি এমন একটি সাজা যা শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।”
তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো গবেষণাই বলে না, অপরাধের শাস্তি অনেক কঠিন হলে অপরাধ কমে আসে। তবু যাঁরা এই ধারণা থেকে মৃত্যুদণ্ড বা কঠোর সাজার বিধানের পক্ষে অবস্থান নেন, তাঁরা আসলে আইন ও সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন না।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য আসামিদেরও অনেক সময় সার্বিক দিক বিবেচনা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে থাকেন আমাদের বিচারকরা।
“অপরাধী যেমনই হোক, তার আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ অবশ্যই থাকবে। রায়ের বিষয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অবশ্যই আইন অনুযায়ী আপিল করার সুযোগ পাবেন। এমনকি, কেউ আইনজীবী নিয়োগে অপারগ হলে সরকার তাঁকে আইনি সেবা দেবে,” যোগ করেন তিনি।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, “সম্প্রতি আইন প্রণয়নের সময় চেষ্টা করা হয়েছে যাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান এড়িয়ে যাওয়া যায়। তবে একটি জিনিস মাথায় রাখতে হয়—প্রতিটি দেশই তার প্রয়োজন ও সার্বিক দিক বিবেচনা করে আইন-কানুন প্রণয়ন করে।”
বতসোয়ানা সরকারের উদ্যোগ চায় লেসেডির পরিবার
জিম্বাবুয়েভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য জিম্বাবুয়ে মেইল এক প্রতিবেদনে জানায়, লেসেডির বাবা গোয়েটসেমোদিমো মোলাপিসি মেয়ের মৃত্যুদণ্ড রোধে বতসোয়ানা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
গোয়েটসেমোদিমো মোলাপিসি বলেন, “আমরা বিষয়টি সরকারের কাছে ন্যস্ত করেছি, তারা আমাদের পক্ষে আপিল করবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে।”
লেসেডি গ্রেপ্তারের পরপরই সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেমোগাং কোয়াপে বলেছিলেন, তাঁরা লেসেডির বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে একজন দূত পাঠাবেন। তিনি আরও বলেন, বতসোয়ানা বাংলাদেশের আইনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
প্রসঙ্গত, বতসোয়ানাও মৃত্যুদণ্ড সমর্থনকারী দেশগুলোর একটি।