বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, তথ্য প্রকাশ করে সাজার মুখে পড়তে পারেন সাংবাদিক ও গবেষকরা
2022.10.05
ঢাকা
দুই ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠানকে সরকার ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে ঘোষণা করায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য প্রকাশ করে সাংবাদিক ও গবেষকরা সাজার মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
তাঁদের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তাও বিপদে পড়তে পারেন, যার ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে তথ্যের অবাধ প্রবাহ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫ ধারার ক্ষমতাবলে এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে বুধবার বেনারকে জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
গত রোববার এই সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তালিকাভুক্ত ২৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি ও রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
“এখন দেখা যাবে সাংবাদিক বা গবেষকরা এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রকাশ করলে তারা শাস্তির আওতায় চলে আসবে। এই তালিকা তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করল,” বেনারকে বলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর এই তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড, সেতু বিভাগ, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ, সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট, সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বাংলাদেশ, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ।
“এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর আওতাভুক্ত করায় এসব প্রতিষ্ঠানের সাইবার সিস্টেমে যে কোনো ধরনের অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধ করা সহজ হবে এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটলে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে,” বলেন পলক।
প্রয়োজনের ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানের তালিকা ভবিষ্যতে আরো বড়ো বা ছোট হতে পারে বলেও জানান তিনি।
সাধারণ মানুষ ‘তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে’
২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ ঘোষণাকে ‘ভয়াবহ ব্যাপার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
বুধবার ঢাকায় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এটা ভয়াবহ ব্যাপার। এই সরকার যে কর্তৃত্ববাদী, এই সিদ্ধান্তে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল আবারও।”
“মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্য প্রবাহ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। দেশের মানুষকে তথ্য পাওয়া সুযোগ বঞ্চিত কারার প্রয়াসেই এই উদ্যোগ,” মন্তব্য করে গেজেটটি প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
এক বিবৃতিতে এই ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে টিআইবি।
এ প্রসঙ্গে টিআইবি প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি সমর্থিত না হওয়ার পরেও এই তালিকার প্রকাশ বেশকিছু মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। টিআইবি মনে করে, এতে করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আমূল সংস্কারের দাবির যৌক্তিকতা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক বা তথ্য পরিকাঠামোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। অথচ সম্প্রতি প্রকাশিত গেজেটে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো বলা হচ্ছে। এ ছাড়া, কোন বিবেচনায় এই তালিকা করা হয়েছে, সেটা স্পষ্ট নয়।”
তাঁর মতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর “তথ্যপ্রাপ্তি থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে।”
অতীতে গণমাধ্যমে তথ্য শেয়ার করায় বহু সৎ সরকারি কর্মচারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রোষানলে পড়ার অনেক নজির আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন একদিকে সরকারি কর্মকর্তা যেমন তথ্য শেয়ার করতে ভয় পাবেন, অন্য দিকে যারা তথ্য প্রকাশ করতে চান না তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর অজুহাত দেখাবেন।”
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপই মানুষকে ভীত করে তোলে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
এই আইনের অনেক ধারা “তথ্যের অবাধ প্রবাহ সীমিত করতে কাজ করে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “কিছু সরকারি সংস্থাকে এই তালিকাভুক্ত করায় এটি নতুন ভয়ের সঞ্চার করবে।”
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপনের মতে, “সাধারণ সেবা প্রদানকারী কম্পিউটার এবং ক্রিটিক্যাল সেবা প্রদানকারী কম্পিউটারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, তাই এই পদক্ষেপ সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রিটিক্যাল সার্ভিসে কোনো বেআইনি বাধার ঘটনা ঘটলে তা প্রশমনে সহায়তা করবে।”
আইন অনুযায়ী, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির মহাপরিচালক, প্রয়োজনে সময়ে সময়ে এই আইনের বিধানগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো নিরীক্ষণ ও পরিদর্শন করবেন এবং সরকারের কাছে এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন।
যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বে-আইনি প্রবেশ করেন বা ক্ষতিসাধন করেন তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সর্বনিম্ন সাত বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের মুখোমুখি হবেন।