যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন: করোনায় বাংলাদেশে মত প্রকাশের অধিকার সংকুচিত

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.03.31
ঢাকা
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন: করোনায় বাংলাদেশে মত প্রকাশের অধিকার সংকুচিত ওয়াশিংটন ডিসিতে ২০২০ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে বক্তব্য রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। ৩০ মার্চ ২০২১।
[এপি]

করোনা মহামারি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টির পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার খর্ব করেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে ২০২০ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে। 

বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার রাতে ওয়াশিংটনে প্রতিবেদনটি উদ্বোধন করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বিশ্বের কিছু দেশ করোনাভাইরাস মহামারিকে সামনে রেখে জনগণের অধিকার খর্ব করে কর্তৃত্ববাদী শাসন পাকাপোক্ত করেছে।”

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হন। এর পর মহামারি ব্যবস্থাপনায় নানা ত্রুটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হন অনেকেই।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, পুলিশ ও সরকারি সংস্থাগুলো সরকারের সমালোচনাকারীদের চিহ্নিত করে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন লোক নিয়োগ করেছে। 

মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তদারকি করে সমালোচনাকারীদের চিহ্নিত করতে সরকার বাড়তি তৎপর হয়ে ওঠে জানিয়ে এতে বলা হয়, মার্চে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করোনাভাইরাস সম্পর্কে ‘গুজব’ ঠেকাতে একটি মনিটরিং সেল গঠন করে তথ্য মন্ত্রণালয়। 

এ ছাড়া বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির ওপর জাতিসংঘের একটি নথির ওপর সংবাদ প্রকাশের পর মার্কিন সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বেনারনিউজের ওয়েবসাইটটি ব্লক করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। উল্লেখ্য, সাইটটি বাংলাদেশ থেকে এখনও দেখা যায় না। 

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে এক আদেশে উচ্চ আদালত বলে, টেলিফোনের কললিস্ট বের করে এবং কথোপকথন রেকর্ড করে জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

“ইদানীং হরহামেশাই বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত কথোপকথনের অডিও এবং ভিডিও বিভিন্ন উদ্দেশ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে,” প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 

প্রতিবেদন আরও বলা হয়, মহামারির মধ্যে সরকারের সমালোচনা করায় ব্যাপকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ প্রয়োগ করা হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

উদাহরণ হিসাবে বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই মর্মে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ১৬ এপ্রিল সকল নার্সদের গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দেয় ডিপার্টমেন্ট অব নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি।

এ ছাড়া ২৩ এপ্রিল সকল চিকিৎসকদেরও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তবে “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো ডাক্তার অথবা সেবিকা সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলতে পারে না,” বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার তিনি বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে আমরাও সেভাবে করেছি। আমরা তাদের অনুসরণ করেছি মাত্র।”

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের “সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রতিবেদনে উল্লিখিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব দেশে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে।”

যুক্তরাষ্ট্রে “গত বছর হাজারের ওপর মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে কয়েক হাজার,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

যুক্তরাষ্ট্রেরে ওই প্রতিবেদনটি “বিভিন্ন সংবাদপত্র ও মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা,” উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এভাবে না করে তাঁরা যদি গঠনমূলক কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করতেন সেটি আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো।”

তবে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তদারকি বিষয়ে প্রতিবেদনের অভিযোগ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

প্রতিবেদন সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চেয়ে বেনারের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা প্রতিবেদনটি পড়েননি জানিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। 

HM_01.JPG
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের বিক্ষোভ। ১ মার্চ ২০২১। [বেনারনিউজ]

‘করোনায় পরিস্থিতি জটিল হয়েছে’

প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৩ মে পরবর্তী সপ্তাহে ১৯ জন সাংবাদিক এবং অন্যান্য নাগরিকের বিরুদ্ধে মানহানি, গুজব ছড়ানো এবং সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বড়ো সংখ্যক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আইনবহির্ভূত ও বিনা বিচারে আটক, সরকারি বাহিনী অথবা তাদের এজেন্টদের দ্বারা গুম, নিষ্ঠুর, অমানবিক ব্যবহার অথবা কঠোর শাস্তি প্রদান, নাগরিকদের ব্যক্তিগত বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, সহিংসতা, সহিংসতার হুমকি ইত্যাদি। 

এ ছাড়া বাংলাদেশে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার, সেন্সরশিপ, ওয়েবসাইট ব্লক, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও একত্রিত হওয়ার অধিকার খর্ব করা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা, দুর্নীতি, সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করাসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

প্রসঙ্গত, সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও করোনাকালে নাগরিকদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করে পোস্ট দিতে থাকেন।

এদের মধ্যে গত বছর মে মাসে আটক হন লেখক মুশতাক আহমেদ ও কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। তাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়।

মুশতাক আহমেদ গত মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর জামিন মেলে কার্টুনিস্ট কিশোরের। জামিন পেয়ে কিশোর অভিযোগ করেন যে, আটকের পর তাঁকে নির্যাতন করা হয়েছিল। 

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদন “প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশ এবং বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করেই প্রস্তুত করা হয়,” বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।

তবে “অন্যান্য বছরের মানবাধিকার প্রতিবেদনের চাইতে এ বছরের প্রতিবেদন আলাদা,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, এর অন্যতম কারণ হলো, “করোনাভাইরাস মহামারি অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।” 

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার অধিকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার অধিকার খর্ব করার প্রবণতা বিশ্বব্যাপী। এটি শুধু আমাদের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।” 

“তবে আমাদের দেশে যা হয়েছে তা হলো বিশ্বব্যাপী এই প্রবণতাকে মডেল বানিয়ে এবং এটিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিকরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করে, সমালোচকদের দমন করে রাজনৈতিক ক্ষমতা সুসংহত করেছেন,” বলেন অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।

তাঁর মতে, “করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই প্রবণতা চলতেই থাকবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।