বাতিল হচ্ছে না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বাড়ছে সাইবার ট্রাইবুনালের সংখ্যা

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.04.07
ঢাকা
বাতিল হচ্ছে না ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বাড়ছে সাইবার ট্রাইবুনালের সংখ্যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় আঁকা একটি দেয়ালচিত্রের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন পথচারী। ৩১ মার্চ ২০২১।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

নানামুখী অপব্যবহারের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে যখন দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন থেকে অব্যাহত দাবি উঠছে, তখন আইনটি বাতিল না করে ওই আইনের মামলা নিষ্পত্তি করতে দেশে সাইবার ট্রাইবুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি করল সরকার। 

বিশ্লেষকদের মতে, দেশে সাইবার ট্রাইবুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি “আশঙ্কাজনক।”

তবে সরকারের মতে ঢাকায় অবস্থিত একমাত্র সাইবার ট্রাইবুনালে সারা দেশ থেকে আসামি ও সাক্ষীদের হাজির করতে যে সমস্যা হতো, বিচার দীর্ঘায়িত হতো, বিভাগীয় শহরগুলোতে ট্রাইবুনাল স্থাপন করায় সেইসব সমস্যা কমে আসবে।

এখন পর্যন্ত দেশের একমাত্র সাইবার আদালতটি ঢাকায়। গত ৪ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকার বাইরে বাকি সাতটি বিভাগীয় শহরে একটি করে সাইবার ট্রাইবুনাল থাকবে। 

ঢাকা থেকে মামলাগুলো ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ওই সব ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করা হবে। 

“সাইবার ও ডিজিটাল অপরাধের বিস্তৃতির কারণে আমরা দেশের আট বিভাগীয় শহরে সাইবার ট্রাইবুনাল স্থাপন করছি। এর ফলে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় জেলাগুলোতে দায়ের করা মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সাইবার ট্রাইবুনালে নিষ্পত্তি করা হবে,” বুধবার বেনারকে বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। 

তাঁর মতে, এর ফলে মানুষের সমস্যা কমে যাবে। কারণ দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইবুনালটি ঢাকায় থাকার কারণে মামলার সাক্ষীদের ঢাকায় হাজির করতে হয়। এর ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেশি লাগে।

“এখন আর এই সমস্যা থাকবে না,” জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, বিভাগীয় শহরগুলোতে ট্রাইবুনাল স্থাপনের কারণে “মামলা পরিচালনায় গতি আসবে।”

তবে মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেছেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “সাইবার ট্রাইবুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের জন্য আশঙ্কাজনক এবং অশনিসংকেত।”

তিনি বলেন, “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের কারণে দেশে–বিদেশে এই আইন বাতিলের দাবি উঠেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকার আইনটি বাতিল না করে ট্রাইবুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।”

“ঢাকার বাইরে আরও সাত বিভাগে সাইবার আদালত স্থাপনের অর্থ হলো, ভবিষ্যতে এই আইনের আরও অপব্যবহার হবে। এটি একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা,” বলেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান। 

সরকার “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারগুলো পর্যালোচনা” করলেও আইনটি “বাতিল হবে না,” জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “এই আইন বাতিল হলে ডিজিটাল ও সাইবার অপরাধের বিচার কী দিয়ে করব?” 

প্রথমবারের মতো ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন পাশ করে বিএনপি সরকার। আইনটির উদ্দেশ্য ছিল, ডিজিটাল মাধ্যমে সংগঠিত অপরাধের বিচার করা।

২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইনে কিছু সংশোধনী আনে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিতর্কিত ৫৭ ধারার অধীনে আনা অভিযোগের সাজা বৃদ্ধি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের আওতায় ঢাকায় দেশের প্রথম সাইবার ট্রাইবুনাল স্থাপন করা হয়। দেশের যে কোনো স্থানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হলে তার বিচারের জন্য ঢাকায় আসতে হতো।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিলসহ কিছু সংশোধনী দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করে আওয়ামী লীগ সরকার।

এই আইনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের চেয়ে আরও কঠোর বলে অভিহিত করে আইনটি বাতিলের দাবি জানায় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম।

সম্পাদক পরিষদ জানায়, আইনটি দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করবে, সংগঠনটি আইনের বেশ কিছু ধারা সংশোধনের দাবি জানায়। 

তবে আইনটি এখন পর্যন্ত সংশোধন করা হয়নি।

উল্লেখ্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলাগুলো সাইবার ট্রাইবুনালে নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। 

সাইবার ট্রাইবুনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে স্থাপনের পর থেকে এ বছর মার্চ পর্যন্ত তিন হাজার ৩২৪টি মামলা বিচারের জন্য ট্রাইবুনালে এসেছে। ওই সময়ের মধ্যে ১২৮টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং নিষ্পত্তিকৃত মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে ৩০টির। 

প্রয়োজন সক্ষমতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য মামলাগুলোর “শতকরা ৮০ ভাগ ফেসবুকে লেখা অথবা কিছু শেয়ার করা সংক্রান্ত অথবা কোনো ছবি আপলোড করা সম্পর্কিত,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা।

তিনি বলেন, “এমন অপরাধের বিচারের জন্য আমাদের দরকার সোশাল মিডিয়া ল্যাব, যার মাধ্যমে অপরাধগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা যাবে। কিন্তু আমাদের সোশাল মিডিয়া ল্যাব নেই।”

“অনেক ক্ষেত্রেই সাইবার মামলার বিচারের সাক্ষ্য হিসাবে স্ক্রিনশট আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এর ভিত্তিতেই বিচার সম্পন্ন করা হয়,” জানিয়ে তিনি বলেন, “স্ক্রিনশট সম্পাদনা করে পরিবর্তন করা যায়। সুতরাং, এই বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।”

ফলে তাঁর মতে, “দেশে সাইবার মামলাগুলো সঠিকভাবে বিচারের ব্যাপারে সরকারকে ভাবতে হবে।” 

ডিজিটাল ও সাইবার অপরাধ তুলনামূলক “নতুন ধরনের অপরাধ,” হওয়ার কারণে এসব “তদন্ত করতে এবং কোনটি অপরাধ কোনটি নয় তা চিহ্নিত করতে পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ দরকার,” বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক। 

“উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক আনা হচ্ছে। আবার আমাদের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “তবে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সময় প্রয়োজন।” 

সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আদালতে সাইবার অপরাধ প্রমাণ করার জন্য আলামত ও প্রমাণ বের করা খুব বড়ো চ্যালেঞ্জ। কারণ সাইবার অপরাধের আলামতগুলো সব সময় থাকে না অথবা কিছুক্ষণ পর মুছে যায়।”

তাঁর মতে, “সারা পৃথিবীতেই আদালতে সাইবার অপরাধের সাজা কম হয়। আমাদের দেশেও কম হয়।”

তবে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধে “সাজা না হলেও মামলা হওয়ার পর যে হয়রানি যায় তা সাজার চেয়ে কম নয়,” বলে মন্তব্য করেন শহিদুল হক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।