ফেসবুক স্ট্যাটাসে মেয়রের মানহানি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক জেলে
2021.04.21
ঢাকা
ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসে সিটি মেয়রের মানহানির দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির খুলনা ব্যুরো প্রধানকে বুধবার কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
খুলনার মেয়র ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আব্দুল খালেক এনটিভির ব্যুরো প্রধান আবু তৈয়বের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন মঙ্গলবার বিকেলে। ওইদিন রাতেই তৈয়বকে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বুধবার ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থিত করা হলে আদালত তৈয়বকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয় বলে বেনারকে জানান খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিএম মনিরুজ্জামান।
“আবু তৈয়বের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে মেয়র খালেকের মানহানি ঘটেছে, এমন অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেছেন মেয়র নিজেই,” বলেন মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেন, আবু তৈয়বের ওই ফেসবুক স্ট্যাটাস নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচার করার অভিযোগে স্থানীয় দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার সাংবাদিক সবুর রানাকেও ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে। সবুর পলাতক রয়েছেন বলে জানান মনিরুজ্জামান।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, খুলনা সিটি মেয়রের দুর্নীতি সংক্রান্ত কিছু তথ্য সংবাদের আকরে ফেসবুকে তুলে ধরেছেন সাংবাদিক তৈয়ব। ওইসব ফেসবুক স্ট্যাটাসের ফলে তাঁর ব্যাপক মানহানি ঘটায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করেছেন বলে বেনারকে জানান মেয়র খালেক।
“আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার কোনোটিই সত্য নয়। এমন অবস্থায় আমি যদি মামলা না করি, তাহলে সাধারণ মানুষ মনে করবে আমি সত্যিই অপরাধ করেছি,” বেনারকে বলেন মেয়র খালেক।
‘মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ’
বাংলাদেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ, তিন মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কমপক্ষে চারজন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক সাংবাদিকদের প্লাটফর্ম ‘আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার।’
এদিকে গত বছর সারা দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯৮টি মামলায় ৪৫৭ জনকে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানা গেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মিডিয়া ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল নাইনটিন-এর তথ্য থেকে।
এই ৪৫৭ জনের মধ্যে ৭৫ জন সাংবাদিক, যাদের ৩২ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতায় পরিষ্কার হস্তক্ষেপ,” বেনারকে বলেন আর্টিকেল নাইনটিন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল।
তিনি বলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই আইনটি ব্যবহার হয় সাংবাদিকদের হয়রানির উদ্দেশ্যে।”
২০১৮ সালে তীব্র বিরোধিতার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ।
গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার কর্মীরা এই আইনের ফলে মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হবার আশংকা প্রকাশ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়, সম্মানিত ব্যক্তিদের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে এই আইনটির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মাস ধরে আটক থাকা লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর আইনটি নিয়ে ব্যাপক সামলোচনার মুখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সরকার আইনটিকে ‘রিভিউ’ করছে যাতে তদন্ত শেষ হবার আগে এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে কিছুটা শিথিলতা আনতে কাজ করছে সরকার।
তিনি বলেন, “মামলা দায়েরের পূর্বে ইনকোয়ারি এবং গ্রেপ্তারের পূর্বে ইনভেস্টিগেশন শেষ হওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।”
কবে নাগাদ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে পারে তা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “চিন্তা-ভাবনা, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, খুব শিগগিরই অগ্রগতি দেখতে পারবেন।”
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবনতি
মঙ্গলবার প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (আরএসএফ) সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চলতি বছরের বার্ষিক সূচক প্রকাশ করেছে।
এতে দেখা যায়, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে (ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ২০২১) গত বছরের তুলনায় একধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। জরিপ করা মোট ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৫২, গত বছর ছিল ১৫১।
সূচক মতে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকারের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে তলানিতে।
গণমাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ, কাজের স্বাধীনতা, সেন্সরশিপ ও দেশের আইনি কাঠামো এবং সংবাদকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নসহ মোট সাতটি মাপকাঠির ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করে আরএসএফ।