সরকার সাংবাদিকদের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ চালাচ্ছে, জাতিসংঘকে ৮ সংস্থার চিঠি

আহম্মদ ফয়েজ
2021.05.03
ঢাকা
সরকার সাংবাদিকদের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ চালাচ্ছে, জাতিসংঘকে ৮ সংস্থার চিঠি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের সমাবেশ। ১ মার্চ ২০২১।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে সাংবাদিক, অধিকার কর্মী ও সমালোচকদের স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর সরকার ‘ক্র্যাকডাউন’ চালাচ্ছে বলে সোমবার অভিযোগ তুলেছে আটটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।  

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশলেকে চিঠি দিয়ে সংস্থাগুলো বলছে, জাতিসংঘের উচিত এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন তাদের ওয়েব সাইটে এই খোলা চিঠি প্রকাশ করেছে। যদিও চিঠির অভিযোগের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও তথ্যসচিব।

চিঠিতে বলা হয়, “যেভাবে বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম ও মুক্ত মত প্রকাশের ওপর আঘাত করে যাচ্ছে, তাতে জাতিসংঘের উচিত দৃঢ়ভাবে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করা এবং স্বাধীন মত প্রকাশের প্রতি দায়িত্ববান ও শ্রদ্ধাশীল হতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা।”

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার এবং সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করতে সাত বছর আগে বিশেষ মেন্ডেট নিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

২০১৮ সালে আবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিয়েছে উল্লেখ করে ওই চিঠিতে বলা হয়, “যেসব সম্পাদক সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশ করেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন ও হয়রানির নীতি অবলম্বন করায় গ্রেপ্তার বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এড়াতে তাঁরা নজিরবিহীন সেলফ সেন্সরশিপ শুরু করেছেন।”

সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত দলীয় নেতা–কর্মীদের হাতে নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নিউজ সাইটগুলো ব্লক করে দেয়া হচ্ছে জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, এমনকি বিদেশে থেকে যারা ইউটিউব ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করছেন তাঁরাও নানাভাবে সরকারের টার্গেট হচ্ছেন।

গত মার্চে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সমালোচনা করে ভারতীয় নিউজ সাইট স্ক্রল–এ বাংলাদেশি এক লেখকের একটি লেখা প্রকাশিত হবার পর বাংলাদেশ থেকে ওই নিউজ সাইটটিতে প্রবেশ করতে সমস্যা হচ্ছিল বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। 

এতে বলা হয়, সরকারের দুর্নীতি উন্মোচন করেছেন অথবা সমালোচনা করেছেন এমন বেশ কয়েক জন সাংবাদিক গত কয়েকমাসে সরকারের আক্রমণের শিকার হয়েছেন।

গত মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে সেখানে কমপক্ষে ১৭ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হন, যাঁদের বেশিরভাগই ফটোগ্রাফার বলেও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।

মোদিবিরোধী ওই বিক্ষোভ চলাকালে ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার সেবা নিয়ন্ত্রিত করার কথাও উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।

এতে বলা হয়, ২০২০ সালে কমপক্ষে ২৪৭জন সাংবাদিক সরকারি কর্মকর্তা বা সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা হামলা, হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।

সাংবাদিক, সমালোচক ও অধিকার কর্মীদের অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখতে অব্যাহতভাবে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করছে উল্লেখ করে বলা হয়, এর ফলে স্বাধীন মত প্রকাশের চর্চা সংকুচিত হচ্ছে।

২০১৮ সালে পাস হওয়া এই আইনটি ব্যবহার করে সরকার সাংবাদিকদের ব্যাপকভাবে হয়রানি করে যাচ্ছে। ২০২০ সালে এই আইনটির অধীনে প্রায় ৯০০ মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামি করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ব্যক্তিকে যাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৫৩জন।

চিঠিলেখা সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে; এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (এএফএডি), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ফোরাম-এশিয়া), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি), এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (অ্যানফ্রেল), কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ) এবং রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস। 

অভিযোগ ভিত্তিহীন: তথ্যসচিব

আট সংস্থার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া বেনারকে বলেন, চিঠিতে যদি বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরকার হস্তক্ষেপ করে, তবে তা মোটেও সত্য নয়।

“আমাদের এই ছোট্ট দেশে শত শত সংবাদপত্র, ৩৪টি টেলিভিশন চ্যানেল চলছে। এ থেকেই বোঝা যায়, সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কতটা বিশ্বাসী,” যোগ করেন সচিব।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওই চিঠি তিনি সোমবার রাত পর্যন্ত দেখেননি জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়ে এমন কথা ওই চিঠিতে থাকলে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন, বানোয়াট।” 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চায় টিআইবি

এদিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে মুক্ত গণমাধ্যম এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে অবিলম্বে স্বাধীন ও পেশাদার গণমাধ্যমের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন সাংবাদিকতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহের সাংবিধানিক ও আইনি প্রতিশ্রুতির বিপরীত উল্লেখ করে আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তবে বাংলাদেশে গণমাধ্যম স্বাধীন ও মুক্তভাবে কাজ করছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তা অবশ্যই একটি উদাহরণ বলে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় গ্রেপ্তার বিষয়ে দেশি-বিদেশি সংগঠনের বিরূপ মন্তব্য সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, “এসব বিবৃতির সাথে একমত হওয়ার কারণ নেই।” 

“তারা নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। আমাদের কাছে বা তথ্য কমিশনের কাছেও কোনো তথ্য চায় না। তাদের ঢালাও মন্তব্য ঠিক নয় এবং আমরা এগুলোর সাথে একমত নই,” বলেন মন্ত্রী। 

“পৃথিবীতে আগে ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না, তাই তখন নিরাপত্তার জন্য আইনেরও প্রয়োজন ছিল না,” মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “প্রয়োজনের কারণে বাংলাদেশে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ করেছে, ভারত-পাকিস্তানসহ সব উন্নত দেশে এ ধরনের আইন আছে।"

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।