সরকারি দল থেকে পদ হারানোর চার দিনের মাথায় গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে হেলেনা জাহাঙ্গীর
2021.07.30
ঢাকা
সরকারি দল আওয়ামী লীগ থেকে পদ হারানোর চার দিনের মাথায় গ্রেপ্তার হয়েছেন আলোচিত ব্যবসায়ী নেতা হেলেনা জাহাঙ্গীর। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্মানহানি করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
দুটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শুক্রবার পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে গুলশান থানা পুলিশ। শুনানির পর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুনানিকালে আত্মপক্ষ সমর্থন করে হেলেনা জাহাঙ্গীর আদালতকে বলেন, “আমি সরকারের লোক, রাষ্ট্রের লোক, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করি। আমি এখনো সরকারি দলে আছি। কারণ বহিষ্কারের কোনো কাগজপত্র এখনও হাতে পাইনি। আমার পদ এখনো আছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ২৫টি দেশ সফর করেছি।”
“সরকারের বিরুদ্ধে আমি কোনো সময় কিছু বলিনি, বরং যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাদের বিরুদ্ধে আমি কথা বলেছি, প্রতিবাদ করেছি, এগুলো অনলাইনে আছে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার মতো কোনো কাজ করিনি।”
কমপক্ষে পাঁচটি মামলার প্রস্তুতি
হেলেনা জাহাঙ্গীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলাসহ মোট পাঁচটি মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে বলে এর আগে জানিয়েছিলেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও টেলিযোগাযোগ আইন, বন্যপ্রাণী আইন, মাদক আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে,” শুক্রবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে বলেন মঈন।
“অভিযানের সময় তাঁর বাসায় ওয়াকিটকি পাওয়ায় টেলিযোগাযোগ আইনে, ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে, মদ পাওয়ায় মাদক আইনে, হরিণের চামড়া পাওয়ায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে এবং বিভিন্নভাবে ‘অপপ্রচার চালানোর’ অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে,” জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার গুলশানে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে আটক করে র্যাব। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চলে।
তাঁর বাসা থেকে মদ, ওয়াকি টকি, ক্যাসিনো সরঞ্জাম ও হরিণের চামড়া উদ্ধারের কথা সাংবাদিকদের জানান ওই অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু।
পরে মিরপুরে হেলেনার মালিকানাধীন জয়যাত্রা আইপিটিভির কার্যালয় এবং জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন ভবনেও অভিযান চালানো হয়। জয়জাত্রা টিভি অফিসে অভিযানে নেতৃত্বদানকারী র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাদির শাহ সাংবাদিকদের বলেন, “টেলিভিশন চ্যানেলটির কোনো বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। তদন্ত করে যদি বৈধ কাগজপত্র না পাওয়া যায় তাহলে চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
“অভিযোগ রয়েছে, জয়যাত্রা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রতিনিধি নিয়োগের নামে অর্থ আদায় করেছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এসব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি,” বলেন তিনি।
অভিযোগ অস্বীকার হেলেনার
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড আইডিতে পোষ্টকৃত জয়জাত্রা টিভির এক প্রতিবেদনে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছিলেন হেলেনা।
তিনি নানা প্রকার সেবামূলক কাজে নিয়োজিত হলেও একটি মহল তাঁকে হেয় করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারে লিপ্ত বলে দাবি করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
তবে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেছেন, “আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা স্বীকার করেছেন, তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের মানহানি ও সুনাম নষ্ট করেছেন।”
হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর পরিচালিত আইপি টিভিতে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা কারণে সমালোচিত ছিলেন তিনি।
সম্প্রতি ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি হিসেবে হেলেনার নাম আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ব্যাপারে আবারও সমালোচনা শুরু হয়। বলা হয়, তিনি ওই সংগঠনের দেশে–বিদেশে কমিটি করার জন্য বিপুল টাকা লেনদেন করেছেন। এর প্রেক্ষিতে তাঁকে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক এবং আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি।
“একজন ব্যবসায়ী এবং নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটিতে স্থান পেয়েছি,” গ্রেপ্তারের পর গণমাধ্যমেক বলেন হেলেনা।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক এস এম কামাল বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ একটি বিশাল দল। দলের বিভিন্ন কমিটিতে অনেক সময় ভুল মানুষ ঢুকে পড়তে পারে। তবে দলে কেউ ঢুকে পড়লেই যে তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে উঠবেন এমনটি নয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দল তা প্রমাণ করেছে।”
“যারা সাইনবোর্ড সর্বস্ব ভূইফোঁড় সংগঠন গড়ে তুলে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে বলা আছে,” বলেন এস এম কামাল।
জয়যাত্রা কার্যালয়ে তালা
রাজধানীর মিরপুরে ‘জয়যাত্রা টেলিভিশন’ কার্যালয় সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, “এই অননুমোদিত টেলিভিশনে কর্মী, সাংবাদিক নিয়োগের নামে হেলেনা জাহাঙ্গীর চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করতেন। চাঁদাবাজি সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি পাওয়া গেছে এবং সেগুলো জব্দ করা হয়েছে।”
অভিযানের পর র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাদির শাহ বলেছিলেন, জয়যাত্রা টিভির ‘কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না।
তবে “হেলেনা জাহাঙ্গীর প্রতিষ্ঠিত জয়যাত্রা আইপি টিভি বন্ধ করে দেওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত,” বলে বেনারকে জানান আর্টিকেল ১৯ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া চ্যাপ্টারের পরিচালক ফারুক ফয়সাল।
তিনি বলেন, “আইপি টিভি একটি নতুন প্রযুক্তি। সরকারের যে পলিসি এখনো হয়নি তা মানতে কোনো নাগরিককে বাধ্য করা যায় না।”
ফারুক ফয়সাল বলেন, “ইন্টারনেট হচ্ছে মানুষের ভাব প্রকাশ বা মত প্রকাশের মুক্তির মাধ্যম। দেশে অনেক অনলাইন টেলিভিশন হয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রেস ফ্রিডমের ওপর হস্তক্ষেপের সামিল।”
“যতক্ষণ আপনি সরকারের প্রিয়ভাজন থাকবেন, ততক্ষণ যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন। কোনো কারণে সরকারের বিরাগভাজন হলেই তাঁর বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে–এটা সরকারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের ঘটনা তারই দৃষ্টান্ত,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বেনারকে বলেছেন, “আইপি টিভি পরিচালনার বিষয়ে সরকারের নীতিমালা দ্রুত চূড়ান্ত করা উচিত। তবেই এই খাতে শৃঙ্খলা আসবে।”
এদিকে নিয়মনীতিহীন আইপি টিভির বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। শুক্রবার দুপুরে মন্ত্রী ঢাকায় তাঁর সরকারি বাসভবনে সাংবাদিকদের এ–সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, “কিছু আইপি টিভি অনেক সময় গুজব রটানোতে যুক্ত হয়, অসত্য তথ্য পরিবেশন ও ভাঁড়ামোতে লিপ্ত হয়। আবার দেখা যায় অনুমোদন পাবার আগেই কেউ কেউ টেলিভিশন চ্যানেলের মতো অফিস খুলে বসেছে, জেলা প্রতিনিধি নিয়োগ দিচ্ছে।”
মন্ত্রী জানান, “মন্ত্রণালয় আইপি টিভিগুলোর কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশনের জন্য দরখাস্ত আহবান করেছিল। পাঁচ শতাধিক দরখাস্ত জমা পড়েছে এবং সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজও আমরা গুছিয়ে এনেছি। যেগুলোর মান ভালো, সেগুলোর নিবন্ধন দেয়া হবে।”