আদালতের আদেশ: আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা চলবে
2021.12.13
ঢাকা
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী ও দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলাটি চলবে বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
২০১৮ সালে ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলাকালে সরকারের বিরুদ্ধে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগে ওই মামলা হয়েছিল।
২০১৯ সালে দায়ের করা রিট আবেদনটি নিষ্পত্তিকালে সোমবার বিচারপতি জে. বি. এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জানায়, শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করতে পারবে পুলিশ এবং মামলাটি চলবে।
শহিদুল আলমের দায়ের করা রিট আবেদনের কারণে পুলিশ এতদিন মামলাটি তদন্ত করতে পারছিল না।
শহিদুল আলমের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “আজকে আদালত আমাদের রিটটি খারিজ করে দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, বিচারাধীন কোনো ফৌজদারি মামলা রিট করে বন্ধ করা যায় না। তাই, শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বাতিলকৃত ৫৭ ধারায় দায়ের করা মামলাটি পুলিশ তদন্ত করতে পারবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের পয়েন্ট হলো, একটি মামলা তখনই বিচারাধীন বলা যায় যখন মামলাটির তদন্ত শেষ হয় এবং চার্জশিটটি আদালতে গৃহীত হয়। কিন্তু শহিদুল আলমের মামলাটির তো তদন্তই হয়নি। সুতরাং, এটি বিচারাধীন মামলা নয়।”
সারা হোসেন বলেন, “আমরা এই মামলাটি তদন্ত করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করি। কারণ, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ করার মাধ্যমে সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করেছে।”
তিনি বলেন, “আইনমন্ত্রী বলেছেন, ৫৭ ধারায় যেসব মামলা বিচারাধীন রয়েছে সেগুলো চলবে। কিন্তু যেসব মামলার তদন্ত হয়নি অর্থাৎ যেগুলো বিচারাধীন নয় সেগুলো মরে যাবে। তাই, শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে এই মামলার তদন্ত চলতে পারে না। মামলাটি চলতে পারে না।”
সারা হোসেন বলেন, “যেহেতু এই ধারা বিলুপ্ত হয়েছে সেহেতু এই ধারায় দায়ের করা মামলা তদন্ত করার এখতিয়ার নেই পুলিশের।”
তিনি বলেন, “এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা দুই-একদিনের মধ্যেই এর বিরুদ্ধে আপিল করব।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় সোমবার বেনারকে বলেন, “আদালতে আমাদের পয়েন্ট ছিল, ফৌজদারি মামলাকে রিট দায়ের করে বন্ধ করা যায় না। আমরা এর পক্ষে বিভিন্ন আইনি পর্যালোচনা দাখিল করেছি। আজকে আদালতও আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, “শহিদুল আলমের রিট আবেদনের কারণে পুলিশ মামলাটি তদন্ত করতে পারছে না। তদন্ত করে যদি দেখা যায় উনি নির্দোষ তাহলে ওনার কিছু হবে না। কিন্তু পুলিশকে তদন্তই করতে দেয়া হবে না, এটা তো ঠিক নয়।”
তুষার কান্তি বলেন, “আপিল বিভাগ এই রায়কে পরিবর্তন না করলে আজকের হাইকোর্টের রায়ের ফলে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলাটি তদন্ত চালিয়ে যেতে পারবে পুলিশ। অর্থাৎ মামলাটি চলবে।”
শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা: পেছনের কথা
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর শহীদ রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর তাঁদের সহপাঠীরা বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে। পরদিন থেকে সেই আন্দোলন ঢাকার অন্যান্য এলাকায় এবং পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে যোগ দেন অনেক অভিভাবক। ফলে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ ধরে রাজধানী ঢাকা সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সরকার নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে ওঠা দাবি মেনে নিয়েছে বলে ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ঘাতক বাস চালক ও মালিককে সাজা দেয়া এবং সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তা ছাড়া দিতে অনুরোধ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে আন্দোলনকারীরা মন্ত্রীর এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যায়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে আক্রমণ চালালে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়।
আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম এই আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তিনি ফেসবুক লাইভে এসে এই আন্দোলনের বিভিন্ন খবর জানাচ্ছিলেন।
চলমান আন্দোলনের মধ্যেই তিনি কাতার ভিত্তিক আল-জাজিরা টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে শুধু নিরাপদ সড়কের আন্দোলন বলে অভিহিত না করে সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেন।
ওই সাক্ষাতকারে তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ বলে মন্তব্য করেন।
শহিদুল আলমের মন্তব্য এবং আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে আক্রমণের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে বিরোধী দলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ করে বলেন, অনেক অছাত্ররা স্কুল পোশাক পরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। এর দুদিন পর পুলিশি অ্যাকশনের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে দমন করে সরকার।
৫ আগস্ট শহিদুল আলমকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ।
পরদিন শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, অনলাইনে ‘ভুয়া ও মিথ্যা’ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন শহিদুল আলম।
পরদিন ৬ আগস্ট তাঁকে আদালতে তোলা হলে শহিদুল আলম অভিযোগ করেন তাঁকে নির্যাতন করে তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করেছে পুলিশ। এরপর তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়।
রিমান্ড আবেদনে আরও বলা হয়, আসামি শহিদুল আলম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ জনমনে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন।
রিমান্ড শেষে ১২ আগস্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
তিনি বার বার আবেদন করলেও তাঁর জামিন নামঞ্জুর হওয়ায় উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করেন শহিদুল আলম।
কয়েক দফা শুনানির পর ১৫ নভেম্বর শহিদুল আলমকে জামিন দেন বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
২০ নভেম্বর রাতে শহিদুল আলম কারাগার থেকে মুক্তি পান।