প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন: বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দেবে না সরকার
2023.08.23
ঢাকা
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে যে তিনটি বিতর্কিত ধারা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সেগুলোর কোনোটিই বাদ দেওয়া হবে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
অ্যামনেস্টির সুপারিশ অনুযায়ী, সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ থেকে ধারা ২১, ২৫ ও ২৮ ধারা বাদ দেওয়া হবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে বুধবার আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “আমি অ্যামনেস্টির চিঠি দেখেছি। আমি বলব, ওই তিন ধারার কোনোটিই বাতিল হবে না।”
গত মঙ্গলবার সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের আইন শাখার উপসচিব মোহাম্মদ ইউসুফকে পাঠানো চিঠিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিংহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে পাস হতে যাওয়া প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি আইন থেকে ওই ধারাগুলো বাদ দেওয়ার আহ্বান জানান।
ওই চিঠির ব্যাপারে আইনমন্ত্রী প্রথমবারের মতো প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “আইনটি বর্তমানে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য ওয়েব সাইটে দেওয়া আছে, যা এই সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে। জনগণের মতামত পর্যালোচনা করে সেটি পাস করার ব্যবস্থা করা হবে।”
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীরা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সুপারিশ সমর্থন করে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি আরেকভাবে থেকে যাচ্ছে।
আইনমন্ত্রীর অবস্থানের ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বুধবার বেনারকে বলেন, “কোনো ধারাই বাদ দেওয়া হবে না—এর অর্থ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আরেকভাবে থেকেই যাচ্ছে। শুধুমাত্র নামে আইনটি পরিবর্তিত হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনও নিবর্তনমূলক কাজে ব্যবহৃত হবে। মানুষের বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা সব কিছু হরণ করতে এই নতুন আইনটিও অপপ্রয়োগ করা হবে।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমস্যা হচ্ছে, সাংবিধানিক অধিকার মত প্রকাশের জন্যও মানুষকে ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত করা হয়। একইভাবে প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি আইনেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। শুধু সাজার মাত্রা কমানো হয়েছে।”
“মত প্রকাশ করা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে ফৌজদারি অপরাধ হতে পারে না,” বলেন নূর খান।
পুরোনো ও নতুন আইনে তফাৎ কেবল সাজায়
ধারা ২১ অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে ডিজিটাল অথবা ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে কোনো ‘অপপ্রচার’ চালানোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এই অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।
২০১৮ সালে সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও একই বিধান রয়েছে। এই আইনে সাজা সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড অথবা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তি।
প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি আইনের ২৫ ধারা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারার প্রতিটি শব্দ হুবহু এক বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। কেবলমাত্র পার্থক্য রয়েছে সাজার মাত্রায়।
ধারা ২৫ অনুযায়ী, কোনো ডিজিটাল অথবা ইলেকট্রনিক্স মাধ্যমে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা অথবা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ ও প্রকাশকে এবং রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ’ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে এই অপরাধের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান করা হয়েছে।
সাইবার সিকিউরিটি আইনের ধারা ২৮ অনুযায়ী, ওয়েব সাইটে অথবা কোনো ইলেকট্রনিক্স বিন্যাসে ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ অথবা ‘অনুভূতিতে আঘাত’ করে এমন কোনো তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও হুবহু একই কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। কেবলমাত্র তফাৎ সাজার মাত্রায়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারার অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড অথবা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় সাজা। সাইবার নিরাপত্তা আইনে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
সাইবার সিকিউরিটি আইনের আরও তিনটি ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
একইসঙ্গে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তি দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
চিঠিতে সংস্থাটি বলেছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো রাখা হয়েছে। এগুলো মত প্রকাশে হুমকি সৃষ্টি করেছে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হয়েছে।
অ্যামনেস্টি বলছে, সাইবার সিকিউরিটি আইনের ষষ্ঠ ভাগের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের হুবহু মিল রয়েছে। দু’টি আইনের মধ্যে কেবলমাত্র একটি তফাৎ; সেটি হলো সাজার মেয়াদ। সাইবার সিকিউরিটি আইনে সাজার পরিমাণ কম এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাজার পরিমাণ বেশি।
সংস্থাটি আরও বলছে, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক কনভেনশনের ১৯ ধারা অনুসারে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা মৌলিক মানবাধিকারের একটি। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা রয়েছে।
অ্যামনেস্টির মতে, ২০০৬ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইন, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং প্রস্তাবিত সাইবার সিকিউরিটি আইন সাংবাদিকদের ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি ও যখন-তখন গ্রেপ্তার করতে এবং সমালোচকদের স্তব্ধ করতে ব্যবহৃত হতে পারে।
প্রস্তাবিত আকারে সাইবার সিকিউরিটি আইন-২০২৩ পাস হলে সেটি হবে বাংলাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
গত এক দশকে সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে যেভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন-২০০৬ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ বিপজ্জনকভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতায় নিবর্তনমূলক বিধানগুলো বাদ না দিয়ে পাস করা হলে সাইবার সিকিউরিটি আইনটি মানবাধিকারকর্মীদের বাধা দিতে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা সংস্থাটির।