ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব মামলা বাতিল চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ১৯ সংস্থার চিঠি
2023.08.31
ঢাকা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে দায়ের হওয়া সব মামলা বাতিলের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছে মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করা ১৯টি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।
প্রধানমন্ত্রীকে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো চিঠির অনুলিপি বুধবার রাতে নিজস্ব ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করেছে বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
এতে বলা হয়েছে, যাঁদের বিরুদ্ধে শুধু শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজের মত প্রকাশের কারণেই এই আইনে মামলা করা হয়েছে, সরকারের উচিত অবিলম্বে সেসব মামলা বাতিল করা।
মামলা দায়েরের পাশাপাশি এসব মামলায় যাদের আটক বা গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয় চিঠিতে।
সম্প্রতি সরকার কর্তৃক গৃহীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাগুলো।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সংবাদ প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আইনি পদক্ষেপ ভয় দেখানোর শামিল, যা একটি স্বাধীন গণমাধ্যমের কার্যক্রমকে রুদ্ধ করে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশাপাশি চিঠিটির অনুলিপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিটি এমন সময় পাঠানো হলো যখন নানা সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গত সোমবার সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে।
খসড়া আইনটি এখন বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। সংসদে বিলটি পাশ হলে রাষ্ট্রপতির সইয়ের পর তা আইনে পরিণত হবে।
চিঠি পাঠানো ১৯ সংস্থার মধ্যে রয়েছে— কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে); অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল; আর্টিকেল নাইনটিন (দক্ষিণ এশিয়া); এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন; বাংলাদেশি জার্নালিস্ট ইন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া; ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট; সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন; কোয়ালিশন ফর উইমেন ইন জার্নালিজম; ফোরাম ফর ফ্রিডম এক্সপ্রেশন, বাংলাদেশ; ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড; আইএফইএক্স; ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস; ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস; ইন্টারন্যাশনাল ওমেন’স মিডিয়া ফাউন্ডেশন; পেন আমেরিকা; পেন বাংলাদেশ; পেন ইন্টারন্যাশনাল; রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ও রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস।
সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ
সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশে সরকারকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন মতামত ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ রেপোটিয়ার আইরিন খান।
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে এই চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ আগস্ট। এতে বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমস্যাযুক্ত ধারাগুলো প্রতিস্থাপিত হওয়ায় এটি উদ্বেগের উদ্রেক করেছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা পর্যাপ্ত বিচারিক তত্ত্বাবধানের অভাবে মানবাধিকারের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশিরভাগ সমস্যাযুক্ত বিধানগুলো খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনে বহাল রাখা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ধারা ২১, ২৫, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২,” বলা হয় চিঠিতে।
ঝুঁকির মুখে স্বাধীন সাংবাদিকতা: টিআইবি
মন্ত্রিসভায় সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বুধবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অভিযোগ করে, সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ এর খসড়ায় নিবর্তনমূলক ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮” এর বিতর্কিত ধারাগুলোর সন্নিবেশ ঘটেছে, যদিও শাস্তি ও অআমলযোগ্য ধারার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। খসড়াটি আইনে পরিণত হওয়ার পরে ডিজিটাল মাধ্যমে মত ও তথ্য প্রকাশ করলে ব্যক্তি আইনি হেনস্তার শিকার হবেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইন জাতীয় সংসদে পাস হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইনে পরিণত হওয়ার এবং এর ফলে সংবিধান প্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার ভূ-লুণ্ঠিত হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক দুর্বলতা খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রয়ে গেছে ও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। খসড়া আইনে মানুষের মৌলিক অধিকার অর্থাৎ মত প্রকাশের অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, বিবেক, চিন্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করার মতো উপাদানগুলো বাস্তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনুরূপ রয়ে গেছে। সুতরাং অতীতের মতো এটিও যে একটি নিবর্তনমূলক আইনে পরিণত হতে চলেছে, এমন ধারণা হওয়া মোটেই অমূলক নয়।”
“এই আইনের ফলে ডিজিটাল মাধ্যমে মত ও তথ্য প্রকাশ করলে ব্যক্তি ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারেন—এমন ধারণাও সাধারণের মধ্যে অধিকতর জোরাল হবে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, সংবিধানে স্পষ্টভাবে ঘোষিত মত প্রকাশ, বাক-স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকারগুলো অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মতো পর্যায়ে আমরা চলে যাচ্ছি। তাই আইনটি যে পর্যায়ে আছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না,” যোগ করেন তিনি।
অনিষ্পন্ন মামলা পুরোনো আইনে চলবে: আইনমন্ত্রী
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি সম্পর্কে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুযায়ী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত হলেও অনিষ্পন্ন মামলাগুলো পুরোনো আইনেই চলবে। এটাই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।”
বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার উদ্বেগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আইনটি সংসদীয় কমিটিতে যাবে, সেখানে সব মতামত নিয়ে আলোচনা হবে।”