ত্রুটিপূর্ণ লিঙ্গের শিশুদের চিকিৎসায় স্বতন্ত্র বহির্বিভাগ চালু

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.12.03
ঢাকা
ত্রুটিপূর্ণ লিঙ্গের শিশুদের চিকিৎসায় স্বতন্ত্র বহির্বিভাগ চালু ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ভবন । ২৭ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

দেশে প্রথমবারের মতো ত্রুটিপূর্ণ লিঙ্গের শিশুদের চিকিৎসার জন্য একটি স্বতন্ত্র বহির্বিভাগ চালু করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল। এই বিভাগে গত ২৮ নভেম্বর থেকে রোগী দেখা শুরু হয়েছে বলে বেনারকে জানান পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ. কে. এম জাহিদ হোসেন।

ওই হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জন নজরুল ইসলাম আকাশ বেনারকে বলেন, যৌনাঙ্গ বিকাশ সমস্যা (ডিএসডি) চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগ খোলার অন্যতম কারণ হচ্ছে, “বর্তমানে ডিএসডি সমস্যায় থাকা শিশুদের অভিভাবকেরা জানেন না যে, এটা চিকিৎসাযোগ্য।”

“তাঁরা জানেন না কোথায় যেতে হবে। আবার অনেকে মনে করেন, এই ধরনের চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। এসব বিষয় বিবেচনা করে বহির্বিভাগটি চালু করা হয়েছে,” বলেন তিনি।

ডা. নজরুল বলেন, “এখানে যেসব রোগী আসবে তাদের পরীক্ষা করে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হবে। পিতামাতার অনুমতি সাপেক্ষে আমরা ডিএসডি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করতে সক্ষম হবো।”

ছোট অবস্থায় অপারেশন করা হলে অনেক মানুষই তৃতীয় লিঙ্গ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে বলে জানান তিনি।

“এখন থেকে প্রতি রোববার বহির্বিভাগে চিকিৎসকরা যৌনাঙ্গ বিকাশ সমস্যা (ডিএসডি) নিয়ে আসা রোগীদের পরীক্ষা করে চিকিৎসা দেবেন, প্রয়োজনে ভর্তি করে অস্ত্রোপচার করে তাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করবেন,” জানান ডা. জাহিদ।

অধিকার কর্মীরা ত্রুটিপূর্ণ যৌনাঙ্গের মানুষদের ইন্টারসেক্স অথবা আন্তঃলিঙ্গীয় জনগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ত্রুটিপূর্ণ লিঙ্গের শিশুদের অভিভাবকের মতামত নিয়ে অপারেশনের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করার বিষয়ে তাঁদের আপত্তি রয়েছে।

ইন্টারসেক্স নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া

আন্তঃলিঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে স্থাপিত প্রথম সরকারি আবাসস্থল দিনাজপুরের মানবপল্লির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেনেকা আহমেদ বাপ্পি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যৌনাঙ্গের বিকাশ সমস্যা সংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগ চালুর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “এটি খুব ভালো খবর। অন্তত একটি হাসপাতাল এ ব্যাপারে চিন্তা করে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য বহির্বিভাগ চালু করেছে।”

“অনেক শিশু ছোটখাটো যৌন বিকাশ সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগে। শিশু অবস্থায় অপারেশন করলে তাদেরকে স্বাভাবিক ছেলে অথবা মেয়ে হিসাবে বড়ো করা যায়,” মন্তব্য করে তিনি বলেন “আমাদের সমাজ ইন্টারসেক্স বাচ্চাদের প্রতি আক্রমণাত্মক। সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা বড়ো হয়ে বাবা-মা বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়।”

তিনি বলেন, “পিতামাতারা এ ধরনের সন্তানের সমস্যা লুকিয়ে রাখে এবং এক পর্যায়ে সামাজিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারে না।”

“কিন্তু পিতামাতারা জানেন না যে, এই সমস্যাগুলোর অধিকাংশই সমাধানযোগ্য। সামান্য অপারেশন করলেই এ ধরনের শিশুকে রক্ষা করা যায়,” বলেন বাপ্পি।

তবে ট্রান্সজেন্ডার নারী অধিকার কর্মী জয়া শিকদার কিছুটা সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানান।

তিনি বেনারকে বলেন, “হাসপাতালে ইন্টারসেক্স জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য একটি বিশেষ বহির্বিভাগ চালু করা একটি ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ এখন থেকে ইন্টারসেক্স শিশুর পিতামাতারা নিদেনপক্ষে একটি স্থানে তাঁদের বাচ্চাদের চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে পারবেন।”

“তবে পিতা-মাতার মতামত নিয়ে অপারেশন করে একটি শিশুকে ছেলে অথবা মেয়েতে রূপান্তর করা যাবে না। ওই শিশুরা সাবালক অথবা সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো প্রকার অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করা গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন তিনি।

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “একজন ইন্টারসেক্স শিশু হয়তো শারীরিকভাবে ছেলের মতো মনে হলেও মানসিকভাবে সে হয়তো মেয়ে। সুতরাং, সেই শিশুর মানসিক অবস্থা বিবেচনা না করে অথবা তার মতামত না নিয়ে মা-বাবার মতামতের ভিত্তিতে শিশুটিকে অপারেশন করে ছেলে করা হলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ।”

“সুতরাং, শিশু অবস্থায় অপারেশন করে লিঙ্গ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়,” বলেন জয়া।

হোচিমিন নামের আরেক ইন্টারসেক্স অধিকার কর্মী বেনারকে বলেন, “যৌনাঙ্গ বিকাশ সমস্যা সাধারণ বিষয়। যেমন কোনো কোনো মানুষের পাঁচটির পরিবর্তে ছয়টি আঙ্গুল থাকতে পারে এবং তারা সেটি নিয়েই বেঁচে থাকে। সুতরাং কোনো শিশুর দুটি যৌনাঙ্গ থাকলেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে অপারেশন করে ছেলে অথবা মেয়ে বানানোর প্রয়োজন নেই।”

তিনি বলেন, “পিতা-মাতাদের উচিত ওই শিশুদের লেখাপড়া শেখানো যাতে তাঁরা বড়ো হয়ে এ ব্যাপারে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”

এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন করতে দেশের ইন্টারসেক্স জনগোষ্ঠী একটি প্রচারণা শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানান হোচিমিন।

ইন্টারসেক্স জনগোষ্ঠীর জন্য বহির্বিভাগ চালুর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “এই ধরনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানবাধিকারের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে যেন কোনো মানুষের অধিকার লঙ্ঘন করা না হয়।”

তিনি বলেন, “শিশুরা তো আর তাদের নিজেদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। সেকারণে চিকিৎসকেরা তাঁদের পিতামাতাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে অস্ত্রোপচার করবেন বলে ধরে নেয়া যায়।”

“কিন্তু সেখানে ভুল হয়ে যেতে পারে। কোনো শিশু শারীরিকভাবে ছেলের মতো দেখালেও সে মানসিকভাবে মেয়ে হতে পারে। সুতরাং, তাঁর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁকে যদি পুরুষ বানানো হয়, তাহলে সেটি হবে বিরাট ভুল,” বলেন নূর খান।

তার মতে, “অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে একটি আইনি কাঠামো তৈরির পর ইন্টারসেক্স শিশুদের অস্ত্রোপচারের বিষয়টি সুরাহা করতে হবে।”

আসছেন অভিভাবকরা

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় একটি জেলা থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে এসেছেন আসমা (প্রকৃত নাম নয়)। তিনি এসেছেন তাঁর ছয় বছরের মেয়ে রুনার (ছদ্মনাম) চিকিৎসার জন্য।

আসমা বেনারকে বলেন, জন্মের সময় তার মেয়ের যৌনাঙ্গের ত্রুটি ছিল না। প্রায় তিন বছর পর থেকে রুনার স্ত্রী যৌনাঙ্গের ওপর একটি পুরুষাঙ্গ গজায়।

“মেয়েকে নিয়ে আমি বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি। সর্বশেষ জানতে পারি ঢাকায় বিএসএমএমইউ হাসপাতালে এই চিকিৎসা হবে। এ জন্য তাকে নিয়ে এসেছি,” জানান আসমা।

দরিদ্র আসমার স্বামী ইজিবাইক চালান। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করেছেন মেয়ের চিকিৎসার জন্য।

“রুনা মেয়ের মতোই আচরণ করে। আমিও তাকে মেয়ের মতো বড়ো করছি। ডাক্তার আমাকে বলেছে, একটি খুব সাধারণ অপারেশন করা হলে সে ভালো হয়ে যাবে,” বলেন আসমা।

এই রোগীর সমস্যা সম্পর্কে ডা. নজরুল বলেন, “মেয়েটির হরমোনের সমস্যা হয়েছে এবং অগ্রিম পিউবারটি এসেছে। তাঁর হরমোনের সমস্যা স্থিতিশীল করে ছোট অপারেশনের মাধ্যমে মেয়েটিকে পরিপূর্ণ মেয়েতে রূপান্তরিত করা যাবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।