সংকট মোকাবেলায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রিয়াদ হোসেন
2024.02.16
ঢাকা
সংকট মোকাবেলায় বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঢাকায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে প্রবেশ করছেন এক নারী। ১৭ জানুয়ারি ২০২৪।
[মো. হাসান/বেনারনিউজ]

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার জমা রেখে টাকা নিতে পারবে, চাইলে সাত থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তা আবার তুলেও নিতে পারবে।

এতদিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে এই লেনদেন ব্যবস্থা ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল করা ও ডলার সংকট কাটাতে স্থানীয় মুদ্রা বিনিময়ের (কারেন্সি সোয়াপ) এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এর আওতায় টাকা জমা রেখেও ডলার নেয়া যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত সার্কুলার প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, মুদ্রা বিনিময়ের জন্য ব্যাংকগুলো ৫০ লাখের ওপরে যে কোনো পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে পারবে।

২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বাড়তে থাকায় দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ওই বছরের মে মাসে চার ধরনের পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ায় সরকার। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে গত বছরের মাঝামাঝিতে প্রবাসী আয়ে বিদ্যমান আড়াই শতাংশ প্রণোদনার বাইরে ব্যাংকগুলোকে আরও আড়াই শতাংশ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিনা প্রশ্নে বিদেশ থেকে নগদ ডলার আনার সীমা দ্বিগুণ করা হয়। কিন্তু তাতেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সাত মাসের ব্যবধানে মোট রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মানদণ্ড অনুযায়ী বিবেচনা করলে রিজার্ভ নেমে গেছে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। অথচ দুই বছর আগে একই সময়ে ছিল দ্বিগুণের বেশি। ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার দর কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দর হারিয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। তবে আমদানিকারকদের দাবি, টাকা দর হারিয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

ডলার সংকটের কারণে আমদানির জন্য এলসি খুলতে প্রতি ডলারের বিপরীতে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০ থেকে ১৪ টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা।

রমজান মাসের জন্য খেজুর আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ডলার প্রতি ১২ টাকা বেশি ব্যয় করতে হয়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, ডলার সংকট। ‘অন্যভাবে’ ডলারের ব্যবস্থা করতে বাড়তি টাকা দিতে হবে।”

সব আমদানিকারকই বাড়তি টাকা নিয়ে এলসি খুলেছে বলে জানান তিনি।

সিরাজুল ছাড়াও অন্তত তিনজন আমদানিকারকের সঙ্গে কথা হয়েছে বেনারের। তাঁরা সবাই জানিয়েছেন, এলসি খুলতে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে ১০ থেকে ১৪ টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হয়েছে।

এদিকে লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বেনারকে জানান, ডলর সংকটের কারণে তিন সপ্তাহ আগে চীন থেকে এক লাখ ১৭ হাজার ডলারের সুতা তৈরির কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারেননি।

“এখন পর্যন্ত ওই এলসি আমি খুলতে পারিনি। এদিকে আমার কারখানায় কাঁচামাল শেষ হয়ে যাচ্ছে। কাঁচামাল আনতে না পারলে দুই সপ্তাহ পর আমার কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে,” বলেন খোরশেদ আলম।

দেশে ডলার সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাজারে ডলার সংকট আছে। তবে ডলার কিনতে ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ বাড়তি খরচের কথা বলছেন, তা নাও হতে পারে।”

নতুন নীতির সাফল্য নিয়ে সংশয়

ডলারের সরবরাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে এবং মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “যেসব ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত ডলার আছে, তারা হয়তো এই কারেন্সি সোয়াপে যেতে পারবে। কিন্তু যাদের ডলার সংকট, তাদের এই পদ্ধতিতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।”

তিনি বলেন, “সার্বিকভাবে এই পদ্ধতি কতটুকু ফল দেবে, তা এখনো পরিষ্কার না।”

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের পরিচালক মো. সারোয়ার হোসেনের মতে, “অনেক ব্যাংকই এই পদ্ধতিতে আসার আগ্রহ দেখাবে।”

“ইতোমধ্যে অন্তত দুটি ব্যাংক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে,” বেনারকে বলেন সারোয়ার হোসেন।

এদিকে, মুদ্রার বিনিময় বাজারভিত্তিক করা না হলে এসব উদ্যোগে ফল আসবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার অর্থ হলো, চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে মুদ্রার মান ঠিক হবে, যা বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফেরও চাওয়া ছিল।

টাকা ও ডলারের অদল-বদলের উদ্যোগ প্রসঙ্গে জাহিদ বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলার রাখলে বাজার দর অনুযায়ী (বর্তমানে প্রতি ডলার ১১০ টাকা) হিসাব হবে, অথচ স্পট হার অনুযায়ী পাবে ১২০ টাকার ওপরে। তাহলে কেন একটি ব্যাংক ডলার রাখতে যাবে?”

একই মন্তব্য করেছেন আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনিও মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

আগামী মে মাসে আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে, মার্চে নিট রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন থাকতে হবে বলে জানিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মুদ্রা বিনিময় চালুর মাধ্যমে হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বাড়ানোর প্রাতিষ্ঠানিক পথ খুলেছে।

তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলোকে হয়তো ‘অনুরোধ’ করা হবে এবং তারা ডলার রাখবে। ফলে রিজার্ভ বাড়বে।”

গত ডিসেম্বরেও অপ্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে সাময়িকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনেছিল বলে জানান তিনি।

তাঁর মতে, বর্তমানে হয়তো বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়নের নিচে রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে না। এটি কেবল আইএমএফকে দেয়।

গত ডিসেম্বরে আইএমএফ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে নিট রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। সংস্থাটি বলছে, আগামী মার্চের মধ্যে থাকতে হবে ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।