বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভেঙে উন্নয়ন তহবিল, স্বচ্ছতাই মূল চ্যালেঞ্জ
2021.03.19
ঢাকা
আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৩:০০
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ ভেঙে গঠন করা অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল পরিচালনায় খুবই সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, স্বচ্ছতার সাথে এই তহবিল পরিচালনা না করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রায় দুইশ’ কোটি ডলার (দুই বিলিয়ন) নিয়ে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশ হতে চাইলে নিজস্ব অর্থে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই তহবিল থেকে তৈরি প্রথম প্রকল্প হিসেবে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের উন্নয়নের জন্য ৬১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল।
তবে তহবিলের বাকি অর্থ কীভাবে ব্যবহার হবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন বড়ো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শেখ হাসিনার সরকার। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ চীন ও ভারত সরকারের কাছ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ঋণ নিয়েছে সরকার।
তবে এই প্রথম বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নিজস্ব উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হলো।
“এটি এক দিক থেকে ভালো যে, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশিদের কাছে যেতে হবে না এবং উচ্চ হারে সুদ দিতে হবে না,” শুক্রবার বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম।
চীনাদের কাছ থেকে নেয়া উন্নয়ন সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে সার্ভিস চার্জ এবং ছয় শতাংশ সুদ দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়া টাকার ক্ষেত্রে তেমন চড়া সুদ দিতে হবে না।
“এখন আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেখান থেকে দুই বিলিয়ন ডলার খুব বেশি নয়,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “রিজার্ভ থেকে সর্বোচ্চ শতকরা ১৫ ভাগের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেয়া ঠিক হবে না। এর বেশি দেয়া হলে সেটি হিতে বিপরীত হতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর জুলাই থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ১৬ দশমিক সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। এটি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
রেমিটেন্সের ওপর ভর করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
সোনালী ব্যাংকের চিফ ফিনেনশিয়াল অফিসার সুভাষ চন্দ্র দাস বেনারকে জানান, পায়রা বন্দর উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা পাবে সোনালী ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক সেই টাকা আগামী তিন বছরে মোট ১২ কিস্তিতে ঋণ হিসেবে দেবে প্রকল্পকে।
এতে সুদের হার দুই শতাংশ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক পাবে এক শতাংশ ও বাংলাদেশ ব্যাংক এক শতাংশ।
সুভাষ জানান, ঋণের কিস্তি ছাড়ের প্রথম তিন বছর প্রকল্পের পক্ষে ছাড়কৃত কিস্তির ওপর দুই শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সাত বছরে সুদসহ পুরো টাকা পরিশোধ করবে পায়রা বন্দর প্রকল্প।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মার্কিন ডলারে অর্থ নিয়ে সোনালী ব্যাংক মার্কিন ডলারেই তা পরিশোধ করার কথা রয়েছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান।
রিজার্ভের এই অংশ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সরকারের জানিয়ে তিনি বলেন “প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও এর অন্যান্য দিকগুলো দেখভাল করবে সোনালী ব্যাংক এবং সরকার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের করণীয় তেমন কিছু নেই।”
রয়েছে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন ঝুঁকি
রিজার্ভ থেকে ধার নিয়ে উন্নয়ন তহবিল গঠনের প্রবণতা নিয়মিত হলে “অত্যন্ত ঝুঁকি রয়েছে” মন্তব্য করে অধ্যাপক ওসমান মাহমুদ বলেন, “ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতি।”
“আমরা সবসময় দেখি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সময় এবং খরচ দুটোই বৃদ্ধি করা হয়। যদি প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায় তাহলে সেটি লোকসানে চলে যেতে পারে। আর প্রকল্প লোকসানি হলে অথবা সেখান থেকে আয় না হলে পুরো বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে,” বলেন তিনি।
প্রায় একই মত প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে টাকা নেয়াটা খুব ভালো নয়।”
“দুই বিলিয়ন ডলার নেয়া হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু এটিকে উদাহরণ হিসাবে নিয়ে এখান থেকে ধার নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেন অভ্যাসে পরিণত না হয়” মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমান ৪৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ “খুব বেশি অর্থ নয়।”
তাঁর মতে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুব বেশি গতিশীল না হওয়ায় আমদানি কম হচ্ছে, ফলে রিজার্ভের অর্থ খরচ হচ্ছে না। এছাড়া বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সও “বেশ ভালো অবস্থায় আছে।”
“ভবিষ্যতে আমাদের আমদানি বাড়বে। আবার যদি কোনো দুর্যোগের কারণে জরুরিভাবে খাদ্যপণ্য অথবা পেট্রোলিয়াম কেনার জন্য বিদেশে অর্থ পরিশোধের দরকার হয়, তাহলে আমরা সমস্যায় পড়তে পারি,” বলেন ড. সালেহ উদ্দিন।
“সেকারণে ভবিষ্যতে রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
এদিকে “সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা অদক্ষ এবং এর কার্যক্রম অস্বচ্ছ,” বলে মন্তব্য করেন ড. সালেহ উদ্দিন।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী ব্যাংক হলমার্ক কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাপক সমালোচিত। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেআইনিভাবে সকল নিয়মকানুন ভেঙে বেসরকারি কোম্পানি হলমার্ককে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ দেয় সোনালী ব্যাংক।
রিজার্ভ থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া “গ্রহণযোগ্য” হলেও এর বেশি অর্থ নেয়াটা “ঝুঁকিপূর্ণ” হবে বলে বেনারকে জানান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “ঝুঁকিপূর্ণ এই কারণে যে এগুলো ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো ভারসাম্য নেই। সরকারই সব।”
“বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিলে প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা, খরচের যৌক্তিকতা, দুর্নীতির সম্ভাবনা ইত্যাদির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোতে এমন কোনো মেকানিজম নেই। সরকার যা বলবে তাই হবে,” বলেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
“সুতরাং, এই ফান্ড সঠিকভাবে পরিচালনা করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ,” যোগ করেন তিনি।
তবে সরকারে প্রকল্প তহবিলের স্বচ্ছতা তদারকি করার কোনো পদ্ধতি নেই এমন অভিযোগের সাথে দ্বিমত করেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বেনারকে বলেন, “পায়রা বন্দরের মতো বড়ো প্রকল্পের খরচ নির্ধারণের জন্য আমাদের বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে, ফলে জার্মানির একটি বিশ্ববিখ্যাত কনসাল্টিং কোম্পানিকে দিয়ে আমরা চ্যানেলের উন্নয়নের খরচ যাচাই করিয়েছি। তাদের মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করেই আমরা পায়রা বন্দর উন্নয়নের জন্য ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করেছি।”
উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ভবিষ্যতেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধার নেয়া হবে কি না সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এক্ষেত্রে আমাদের একটা নীতিমালা প্রয়োজন হবে, নীতিমালা তৈরির জন্য আমরা কাজ করছি।”
আপডেট: মূল প্রতিবেদনে ভুলক্রমে তহবিলের পুরো দুই বিলিয়ন ডলার পায়রা বন্দর প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই ভুল সংশোধন করা হলো।