তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়োগে উৎসাহ দিতে বাজেটে কর ছাড়ের প্রস্তাব

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.06.03
ঢাকা
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়োগে উৎসাহ দিতে বাজেটে কর ছাড়ের প্রস্তাব ঢাকার একটি বিউটি পার্লারে কাজ করছেন তৃতীয় লিঙ্গের একজন কর্মী। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষদের সমাজের মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় বাজেটে কর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ সালের প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের ১০ শতাংশ অথবা ১০০ জনের বেশি ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয় তবে ওই কর্মচারীদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫ শতাংশ বা প্রদেয় করের পাঁচ শতাংশ, নিয়োগকারীকে রেয়াত দেয়া হবে।

এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সর্বনিম্ন করসীমা তিন লাখের পরিবর্তে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। 

সংসদের নিয়ম অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনার পর আগামী ৩০ জুনের মধ্যে পাশ হলে তা আইনে পরিণত হবে। জুলাই থেকে শুরু হবে পরবর্তী ২০২১-২২ অর্থবছর।

সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি ও বিএনপি এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় বাজেটে এমন প্রস্তাব দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

‘খুব ভালো উদ্যোগ’

বাজেটের এই প্রস্তাবনাটিকে “খুব ভালো উদ্যোগ” বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ। 

বৃহস্পতিবার তিনি বেনারকে বলেন, “এই সিদ্ধান্তের ফলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ব্যাপারে সমাজে যে নেতিবাচক ধারণা আছে সেটি থেকে মানুষকে বের করে এনে এদের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।”

“সরকারের এই ঘোষণার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে। ফলে এই মানুষগুলোর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সমাজে তাঁরা মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকবে পারবে,” বলেন সালেহ আহমেদ। 

তবে তাঁর মতে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়োগ দেবার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত কিছুটা শিথিল করতে হবে। কারণ “সামাজিক অবহেলা ও অসহযোগিতার জন্য এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলো খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারে না।” 

এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্বও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। 

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করা অন্য একটি বেসরকারি সংগঠনের প্রধান হো চি মিন এই উদ্যোগকে একটি ‘বিরাট পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করে বেনারকে বলেন, এর ফলে “যৌন সংখ্যালঘু মানুষদের জীবনে বড় পরিবর্তন আসবে। প্রতিষ্ঠানগুলো এই মানুষগুলোকে আর বোঝা ভাববে না।” 

তবে তাঁর মতে, সাধারণভাবে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া হিসেবে পরিচিত যৌন সংখ্যালঘুদের জীবনের গুণগত মানের পরিবর্তন আনতে গেলে “শিক্ষা দিতে হবে এবং ক্ষমতায়িত করতে হবে।” 

“সরকারের এই ঘোষণার ফলে এই শ্রেণির মানুষগুলোর ক্ষমতায়িত হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে,”যোগ করেন হো চি মিন। 

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য কর রেয়াতের প্রস্তাবকে “একটি বড় ঘটনা” হিসেবে আখ্যায়িত করে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বেনারকে বলেন, “আমরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ব্যাপারে তেমন কিছুই করিনি, করছি না। এদের সমাজের বোঝা হিসাবে না দেখে সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।” 

প্রস্তাবিত বাজেটে কর অব্যাহতি এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আয়করের সর্বনিম্ন সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবকে সমর্থন করে বিএনপি সাংসদ হারুনুর রশিদ বেনারকে বলেন, “দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এই দুটি প্রস্তাবের কারণে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে। এরা রাস্তাঘাটে ভিক্ষা করে বেড়াবে না।”

বাংলাদেশে সাধারণভাবে হিজড়া নামে পরিচিত মানুষরা ২০১৩ সাল থেকে সরকারিভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃত। এই পরিচয়েই তাঁরা ভোট দিতে ও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তবে সালেহ আহমেদের মতে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে, যদিও এ সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান নেই।

“আশার কথা হলো, এই বছর যে আদমশুমারি হতে যাচ্ছে সেখানে প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা বের করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো,” বলেন সালেহ আহমেদ।

বাংলাদেশে জনশুমারির চূড়ান্ত জরিপ চলতি বছরের জানুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হলে নভেম্বর নাগাদ তা হতে পারে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তারা। 

জীবন-জীবিকার বাজেট

করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে ‘জীবন-জীবিকায়’ প্রাধান্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সংসদে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। 

প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছয় লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে ঘাটতি দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ এবারও বড় ঘাটতির বাজেট। 

গত ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি এক লাখ ৮৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫০তম ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।