ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির আগে শর্ত পর্যালোচনার জন্য আইএমএফ দল ঢাকায়
2023.10.03
ঢাকা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাবার জন্য সরকার বেশকিছু শর্ত পূর্ণাঙ্গ বা আংশিকভাবে পালন করলেও বড়ো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থতা।
চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, যা সাত কিস্তিতে সাড়ে তিন বছরে পাবে বাংলাদেশ।
ঋণ দেওয়ার সময় সংস্থাটি শর্ত হিসেবে ছোট-বড়ো ৩০টির বেশি কর্মসূচির সময়সীমাও ঠিক করে দিয়েছে। প্রতিটি কিস্তি ছাড় করার আগে সংস্থাটি এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে বৈশ্বিক ঋণদাতা এই সংস্থাটি। আগামী নভেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সংস্থাটির একটি দল মঙ্গলবার থেকে ঢাকা সফর করবে।
বুধবার (৫ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের দেওয়া শর্তের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ও জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে যে ফর্মুলা সরকার ঘোষণার কথা তা করেনি।
“এর মধ্যে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যথা হলো লক্ষ্য অনুযায়ী রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে না পারা,” বেনারকে বলেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
রিজার্ভ সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করলেও মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না হওয়া এবং প্রবাসী আয় দেশে আনতে না পারাটাই বড়ো কারণ।”
আইএমএফে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, এসব কারণে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে জটিলতা তৈরি করতে পারে।
বেনারকে তিনি বলেন, “তারা হয়তো নতুন করে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিতে পারে, কিংবা কিস্তি ছাড় করা পিছিয়ে দিতে পারে।”
উদ্বেগের জায়গা রিজার্ভ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তীতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির পর আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত বছরের জুলাইয়ে সংস্থাটির কাছে ঋণ চায় বাংলাদেশ। চলতি বছরের জানুয়ারির ৩১ তারিখ বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদন করে সংস্থাটি।
ঋণের সাথে আইএমএফ এর দেয়া শর্তের অন্যতম ছিল গত জুনের মধ্যে সংস্থাটির হিসাব মান অনুযায়ী রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকবে। আর সেপ্টেম্বরে থাকবে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ নেমে এসেছে ২১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
“নির্বাচনের কারণে টাকা পাচার বেড়েছে, আরো বাড়বে। সেজন্য আমাদের রিজার্ভ কমছে। প্রবাসী আয় কম আসছে। রপ্তানির টাকাও কম আসছে। আগামী দিনগুলোতে এই রিজার্ভ আরো কমতে পারে,” বলেন ড. আহসান এইচ মনসুর।
রিজার্ভ এবং মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের “উদ্বেগের জায়গা” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আইএমএফ এর আলোচনায় এসব বিষয় আসবে।”
তবে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান মনে করেন, রিজার্ভ এখনো “স্বস্তির জায়গায়” আছে।
গত রোববার বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাত শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রিজার্ভ যদি এখন ২১ বিলিয়ন ডলারও হয়, আমাদের আমদানি তো ৫ বিলিয়ন ডলারে (প্রতি মাসে গড়ে) নেমে এসেছে। তার মানে চার মাস আমদানির ব্যয় নির্বাহ করার সুযোগ আছে। চার মাস খুবই স্বস্তিদায়ক রিজার্ভ।”
তবে তাঁর মতে, আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে কোনো সমস্যা হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত এক বছরে রিজার্ভ কমে গেছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার।
আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবার কথা রয়েছে। ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, “নির্বাচনের আগে খাদ্য পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানি কমানো যাবে না। লোডশেডিং কমানোর চেষ্টা করতে হবে, সেজন্য জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতে খরচ বাড়বে।”
এর ফলে নির্বাচনের পর রিজার্ভ কমে হয়তো আরো নেমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা তার।
আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে রিজার্ভ ছাড়াও গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি।
মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়া হলেও আংশিক কার্যকর হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
বেনারের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের আলোচনার বিষয়বস্তু জানতে আইএমএফকে মেইল পাঠানো হলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইএমএফ এর দেওয়া ঋণের প্রথম পর্যালোচনার অংশ হিসেবে পরামর্শক সভা হবে।
তবে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আর কিছু জানায় নিয় সংস্থাটি। ঋণের শর্ত পূরণে বাংলাদেশের ব্যর্থতায় ফলাফল কী হতে পারে সে বিষয়েও কোনো মন্তব্য করেনি সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হকও আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে রাজি হন নি। বেনারকে তিনি বলেন, প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর এ বিষয়ে জানানো হবে।