তাপপ্রবাহ: প্রধান ফসল বোরো ধানের উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.04.11
ঢাকা
তাপপ্রবাহ: প্রধান ফসল বোরো ধানের উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা সিলেটের খাদিম নগর ইউনিয়নের উফতার হাওরে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে ছত্রাক আক্রান্ত ধান কেটে ফেলছেন কৃষক জালাল মিয়া (ডানে)। ৩ এপ্রিল ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

গত সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহ আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে—আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন সতর্কবার্তার পর দেশের প্রধান ফসল বোরো ধানের উৎপাদন রক্ষা করতে কৃষকদের তৎপর থাকতে বলেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

কৃষি বিভাগ বলছে, মাঠে পাকার পর্যায়ে রয়েছে বোরো ধান। এই সময়ে খেতে পানি না থাকলে অথবা তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি অব্যাহত থাকলে বোরো উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

এর প্রভাব পড়বে দেশের সার্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়।

তাপপ্রবাহ থেকে উৎপাদন রক্ষা করতে সোমবার কৃষকদের সতর্কতা জারি করে বলা হয়েছে, তাঁরা যেন ধান খেতে কমপক্ষে দুই ইঞ্চি সেচ নিশ্চিত করেন।

তবে পানি পেতে হাহাকার শুরু হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও দেশের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরের ১৬ জেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ও বেসরকারি অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ অব্যাহত রয়েছে।

মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ।

সংশ্লিষ্টদের মতে, পানি নিশ্চিত করলেই ফসল রক্ষা করা যাবে এমনটি নয়। কারণ তাপমাত্রা সহনশীলতার চেয়ে বেশি হলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

MRHK_11042023_00A4455 copy.jpg
গরমের অস্বস্তি থেকে বাঁচতে সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের একটি খালে জলকেলি করছে শিশুরা। ১১ এপ্রিল ২০২৩। [বেনারনিউজ]

বোরো ধান পুরোটাই পানি নির্ভর

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের শস্য শাখার পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বোরো আমাদের দেশের মূল ধান। এটি পুরোটিই পানি নির্ভর। বর্তমান সময় বোরো ধানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন পানি না থাকলে ধানের উৎপাদন বেশ ক্ষতি হতে পারে।”

তিনি বলেন, “বর্তমানে যে তাপদাহ চলছে সেটি যাতে বোরো ধানের কোনো ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য কৃষকরা তাদের জমিতে দুই ইঞ্চি পানি সেচ নিশ্চিত করেন সেই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পানি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সমস্যা থাকবে না।” 

স্বপন কুমার বলেন, “অঞ্চল ভেদে এপ্রিলের শেষ থেকে বোরো ধান কাটা শুরু হবে। এই কয়েকটি দিন আমাদের সচেতন থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “শুধু ধান নয়। বর্তমান সময় আমের জন্য এবং বিভিন্ন সবজি চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে এই তাপদাহে করণীয় সম্পর্কে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”

সোমবার আবহাওয়া অধিদপ্তর দেশে চলমান তাপদাহের ব্যাপারে সতর্কবার্তা প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কোথাও ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং কোনো কোনো অঞ্চলে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তাপপ্রবাহ চলমান রয়েছে। এই তাপপ্রবাহ আগামী সাত দিন অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

সতর্কবার্তায় বলা হয়, রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের দুই এক জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় তিন কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে বোরোর পরিমাণ দুই কোটি ১০ লাখ টনের মতো। অর্থাৎ দেশের মোট উৎপাদিত চালের শতকরা ৫০ ভাগের বেশিই বোরো।

দেশের মোট খাদ্য চাহিদার পুরোটাই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তবে বাজার ব্যবস্থায় একচেটিয়া প্রভাবমুক্ত রাখতে সরকার চাল আমদানি করে থাকে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ওয়াইস কবির মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে কৃষকদের জন্য যে উপদেশ দেওয়া হয়েছে সেটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত।”

তিনি বলেন, “প্রতিটি ফসলের জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন। এর কম বেশি হলে ফলনে সমস্যা দেখা দেয়। যেমন ধানের ক্ষেত্রে ৩৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা কয়েকদিন থাকলে এবং ১০ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকলে ধানের দানা চিটা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।”

ওয়াইস কবির বলেন, “এই তাপদাহে খেতে যদি পানি থাকে অথবা নিয়মিত সেচ দেওয়া হয় তাহলে পানি জলীয় বাষ্প হয়ে খেতকে ঠাণ্ডা রাখবে। এতে ফসলের উৎপাদন ঠিক থাকার সম্ভাবনা থাকে।”

তিনি বলেন, “বোরো ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। বোরো উৎপাদন ব্যাহত হলে আমাদের খাদ্য সরবরাহে সমস্যা হবে।”

নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার কৃষক মাসুদুর রহমান টিক্কা মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বর্তমানে যে তাপপ্রবাহ চলছে তাতে খেতে প্রায় প্রতিদিনেই সেচ দিতে হচ্ছে। তাপের কারণে খুব তাড়াতাড়ি পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘনঘন সেচ দেওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বাড়বে।”

তিনি বলেন, “পানির প্রায় পুরোটাই আসছে অগভীর টিউবওয়েল থেকে। নদী, নালা, খালে পানি নেই বললেই চলে। আবার সবাই নদীর পানি সেচের সুবিধা পায় না।”

“তবে একটি বড়ো সুবিধা হলো, বিদ্যুৎ বিভ্রাট নেই। সে কারণে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারত। তবে এখন পর্যন্ত ধানের অবস্থা বেশ ভালো। যদি আবহাওয়া খারাপ না হয় তাহলে এবার খুব ভালো ফলন পাওয়া যাবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে,” বলেন টিক্কা।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রশীদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বর্তমানে চলমান তাপদাহ দেশের উত্তরাঞ্চলে হাহাকার সৃষ্টি করেছে। সবাই একসঙ্গে পানি চায়।”

তিনি বলেন, “এই তাপদাহে নদী, নালা, খাল প্রায় শুকিয়ে গেছে এবং পানির জন্য ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।”

আব্দুর রশীদ বলেন, “মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে কিছু কিছু জায়গায় যেখানে ৭০ ফুটে পানি পাওয়া যেত সেখানে এখন ৭৫ ফুট নিচ থেকে পানি উত্তোলন করতে হচ্ছে।”

“শুধু ধানের জন্য নয়। নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আম প্রধান অঞ্চলে আম গাছে পানি দিচ্ছেন কৃষকরা,” বলেন তিনি।

আব্দুর রশীদ বলেন, “এখন পর্যন্ত যা দেখছি তাতে উৎপাদনের সমস্যা হবে না। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে সমস্যা বাড়তে পারে। দেখা যাক কী হয়!”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।