কুমিল্লা সিটি নির্বাচন: শেষ মুহূর্তের চমকে বিজয়ী আ.লীগ প্রার্থী

আহম্মদ ফয়েজ
2022.06.15
ঢাকা
কুমিল্লা সিটি নির্বাচন: শেষ মুহূর্তের চমকে বিজয়ী আ.লীগ প্রার্থী কুমিল্লার একটি ভোট কেন্দ্রে এক ভোটারকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পদ্ধতি বুঝিয়ে দিচ্ছেন পোলিং অফিসার। ১৫ জুন ২০২২।
[বেনারনিউজ]

অল্প ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কুকে পরাজিত করে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত।

নৌকা প্রতীক নিয়ে রিফাত ৫০ হাজার ৩১০ ভোট এবং তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দুইবারের সদ্য সাবেক মেয়র সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী।

অপর দিকে ঘোড়া প্রতীকে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার পেয়েছেন ২৯ হাজারের বেশি ভোট।

বুধবার সকাল ৮টা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে সাধারণ ভোটাররা দিনভর ভোট দিয়েছেন। কুমিল্লা নির্বাচন নিয়ে গত কয়েকদিন রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ালেও ভোট চলাকালে সহিংসতার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

তবে, রাতে নির্বাচনের ফল ঘোষণার শেষ পর্যায়ে এসে উত্তেজনা দেখা দেয়। ১০৫ কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টির ফল ঘোষণা হওয়ার পর যখন এগিয়ে ছিলেন সাক্কু, সে সময় তাঁর সমর্থকেরা স্লোগান দিয়ে ভোটের ফল ঘোষণার স্থান কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করেন।

এর মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষণা দেন, মেয়র পদে আর অল্প কিছু কেন্দ্রের ফল ঘোষণা বাকি আছে। সে সব কেন্দ্র থেকে ফল আসতে দেরি হচ্ছে। এখন তারা কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোটের ফল ঘোষণা করতে চান।

তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সাক্কুর সমর্থকেরা। তাঁরা ফল ঘোষণার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর একদল নেতাকর্মী নিয়ে মনিরুল হক সেখানে আসেন। এ সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ ধাক্কাধাক্কি করে মনিরুল হকের সমর্থকদের পাশে সরিয়ে দেন।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে মনিরুল হক কয়েকজন নেতাকর্মীকে নিয়ে ফল ঘোষণা মঞ্চের সামনে বসে পড়েন। এর আধা ঘণ্টাখানেক পর আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন। এ সময় দুপক্ষে হাতাহাতি হয়। পরে পুলিশ তাদের লাঠিচার্জ করে।

নতুন ইসির প্রথম নির্বাচন

নানা আলোচনা সমালোচনার মধ্যে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনের আয়োজন করল। কুসিক নির্বাচনের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঁচটি পৌরসভা ও প্রায় ১২০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো ‘নির্বাচনী পরীক্ষায়’ বসল এই ইসি।

প্রথম নির্বাচন হওয়ায় এটি নিয়ে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকদের ছিল প্রখর দৃষ্টি। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে কিনা এই নির্বাচন, তা নিয়ে নানা রকম আলোচনা সমালোচনার ছিল।

বুধবার নির্বাচন শেষে রাজধানীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল বলেন, “পরীক্ষায় কোন ডিভিশন পেলাম মানুষ তার মূল্যায়ন করবে।”

অপরদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, এই নির্বাচনে নতুন ইসির জন্য কিছু সফলতা ও কিছু ব্যর্থতা রয়েছে।

তিনি বেনারকে বলেন, “নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্যকে নির্দেশনা দেয়ার পরও তিনি এলাকা ছাড়েননি। এখানে ইসির অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, এটা তাদের বড়ো ব্যর্থতা।”

গত নির্বাচন কমিশন আয়োজিত নির্বাচনগুলোতে যেরূপ সহিংসতা দেখা গেছে এবারের নির্বাচনে তেমনি দেখা না যাওয়া বর্তমান কমিশনের সাফল্য বলে মনে করেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।

তাঁর মতে, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) অধিকাংশ মানুষের আস্থা না থাকার পরেও কুমিল্লা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ‘ইসির ঠিক হয়নি’।

নতুন ইসির প্রথম নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে বলেন, “এই সরকারের আমলে বা নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন নিয়েই আগ্রহ নেই বিএনপির। নির্বাচন ভালো হোক বা মন্দ হোক সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়, আমাদের পরিষ্কার অবস্থান হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে।”

এদিকে ঠাকুরগাঁও নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কুসিক নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। একজন সংসদ সদস্যকে তারা কুমিল্লা থেকে বের করতে না পেরে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

ইভিএম নিয়ে অসন্তোষ, জটিলতা

ইভিএম নিয়ে নানা বিতর্কের পরও বিভিন্ন নির্বাচনে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করেই আসছে ইসি। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে পুরো ভোটই নেয়া হয়েছে ইভিএমের মাধ্যমে। ভোট গ্রহণ শুরু হবার পর থেকেই ভোটার ও প্রার্থীরা ইভিএম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেন।

কিছু কিছু কেন্দ্রে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভোট গ্রহণ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে আবার কোথাও কোথাও ভোট শুরু হলেও ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন ভোটাররা।

শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কুমিল্লা হাইস্কুল নারী ভোটার কেন্দ্রে ইভিএম মেশিনে ত্রুটির কারণে ৪১ মিনিট ভোটগ্রহণে বিলম্ব হয়। ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ফজলুল করিম সাংবাদিকদের জানান, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভোট শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়েছে।

সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকজন ভোটার অভিযোগ করেছেন, ভোটকেন্দ্রে ব্যবহৃত ইভিএম শুধুমাত্র 'নৌকা মার্কা' দেখাচ্ছে। তাঁদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক নেউরা এমআই হাইস্কুল ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করলেও গোপন কক্ষে ঢুকতে পারেননি।

ফারুকের দাবি, কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার তাঁকে বুথে ঢুকতে দেয়নি।

“ভোটারদের অভিযোগ যাচাই করতেই এসেছি। কিন্তু আমি ভোটকেন্দ্রে ঢুকে ইভিএম কীভাবে কাজ করছে তা দেখতে চাইলে প্রিসাইডিং অফিসার আমাকে বাধা দেন। আমাকে অবিলম্বে চলে যেতে বলা হয়েছে,” সাংবাদিকদের বলেন ফারুক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার নাজমুল আমিন বলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে ঢুকতে চেয়েছিলেন। আমি ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে বলেছিলাম যে আপনি গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। এটা বৈধ নয়। এ বিষয়ে আমি আপনাকে অনুমতি দিতে পারি না।”

তিনি আরও দাবি করেন, মেশিনগুলো ঠিক আছে এবং প্রযুক্তি দল পরীক্ষা করে কোনো সমস্যা পায়নি।

এছাড়াও ইভিএমের ধীর গতির কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন কেন্দ্র ভোটাররা।

আঙুলের ছাপ না মেলায় কোনো কোনো ভোটার একাধিকবার চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন।

তবে সিইসি আউয়াল বলেন, “আমাদের মতে ইভিএমে ভোট ভালো হয়েছে। কিছু কিছু ভোটার কিছুটা অসুবিধায় পড়েছেন এগুলো ভবিষ্যতে এড্রেস (সমাধান) করা হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।