আর্থিক সংকটে ইভিএম কেনা থেকে সরল সরকার
2023.01.23
ঢাকা
আর্থিক সংকটে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনতে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব বাতিল করেছে সরকার।
বিরোধীদলীয় জোটের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে আট হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় সম্বলিত একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম সোমবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান, পরিকল্পনা কমিশন রোববার নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে যে, আপাতত এই প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে না।
কোনো সরকারি প্রকল্পই একনেকের অনুমোদন ব্যতিরেকে বাস্তবায়িত হয় না।
ক্ষমতাসীন দল ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোটের মধ্যে অন্যতম মতপার্থক্যের বিষয় হলো ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ।
বিএনপির অভিযোগ, ইভিএম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, ইভিএম দিয়ে জালিয়াতি করা অসম্ভব।
‘পরবর্তী পর্যায়ে হবে’
প্রকল্পটির অনুমোদন সম্পর্কে জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, পরিকল্পনা কমিশন রোববার নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে, আপাতত এই প্রকল্প একনেকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে না।
পরিকল্পনা কমিশনের চিঠি সাংবাদিকদের সামনে পড়ে শোনান সচিব।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “নির্বাচন ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বৃদ্ধি ও টেকসই ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রকল্প প্রস্তাবটি বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করে এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সরকারের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় আপাতত প্রক্রিয়াকরণ না করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।”
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “অর্থাৎ পরিকল্পনা কমিশন আমাদের জানিয়েছে যে, এই মুহূর্তে এই প্রকল্পটির কার্যক্রম প্রক্রিয়াকরণ করছেন না।”
তিনি বলেন, “এটি বাতিল হচ্ছে না। … পরবর্তী পর্যায়ে করা হবে।” তবে কখন এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে সে ব্যাপারে তিনি কোনো ধারণা দেননি।
সচিব বলেন, নির্বাচন কমিশনের হাতে দেড় লাখ ইভিএম রয়েছে এবং সেগুলো দিয়ে আগামী নির্বাচনে ৫০ থেকে ৭০ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হবে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগ বলছে, বিরোধী দলের আপত্তির কথা বিবেচনায় নিয়েই ইভিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেনি সরকার।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান সোমবার বেনারকে বলেন, “সরকার যে শুধু আর্থিক কারণে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়নি বিষয়টি তা নয়। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি রাজনৈতিক ছাড় রয়েছে।”
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশগ্রহণ করুক। যেহেতু তারা বিরোধিতা করছে সেহেতু আমরা প্রকল্পটি বাদ দিয়েছি।”
বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন সোমবার বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ যে বলছে তারা আমাদের, অর্থাৎ বিরোধীদলের আপত্তির কারণে ইভিএম বাতিল করেছে-এই কথা ঠিক না। মূলত অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং ডলার সংকটের কারণেই এই প্রকল্প অনুমোদন দেয়নি পরিকল্পনা কমিশন।”
তিনি বলেন, “এই প্রকল্প অনুমোদন না দিয়ে সরকার কোনো প্রকার রাজনৈতিক সততা প্রদর্শন করেনি। এর মধ্যে কোনো রাজনৈতিক সততা নেই। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকার পরও যদি তারা প্রকল্পটি বাদ দিতেন তাহলে দেশের জনগণ তাদের বিশ্বাস করত।”
জহির উদ্দীন স্বপন বলেন, “সত্যি কথা বলতে গেলে, বর্তমানে রাজনৈতিক সততা দেখানোর সময়ও পার হয়ে গেছে।”
ইভিএম কেন?
ইভিএম যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটাররা তাদের হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে বোতাম টিপে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
ভোটাররা যে প্রতীকে ভোট দেবেন সেই প্রতীকের পাশের বোতাম টিপলেই ভোট দেওয়া হয়ে যায়।
নির্বাচনকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় এনে দ্রুত ফলাফল প্রকাশ করতে দেশে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ইভিএম প্রবর্তন করে শামসুল হুদা কমিশন।
সেই বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। ওই ইভিএম তৈরি করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল।
এরপর থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে আসছে কমিশন। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনেও ঢাকার কিছু আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়।
কমিশনের হিসাবে এ পর্যন্ত প্রায় নয়শ’ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। নির্বাচনগুলোর প্রায় সবই স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
তবে শুরু থেকেই ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ইভিএম ব্যবহারকে ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচন জালিয়াতি করার একটি উপায় বলে আখ্যা দিয়ে আসছে দলটি।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
সাবেক নির্বাচন কমিশনার (অব.) ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “ইভিএমগুলো মূলত চীনা। চীন থেকে সব যন্ত্রপাতি আমদানি করে আনা হয়, এরপর সেগুলো অ্যাসেম্বল করে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়।”
তিনি বলেন, “মেশিনগুলো খুব ধীর গতির। ইভিএম ভোট প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। মানুষ ভোট দিতে পারে না, চলে যায়। এগুলো নতুন কথা নয়।”
সাখাওয়াত বলেন, “ভোট প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ার কারণ হলো, অনেক সময় ভোটারদের আঙুলের ছাপ মেলে না। বারবার চেষ্টা করতে হয়, ফলে ভোট দিতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়।”
“এছাড়া, এই ইভিএম নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য রয়েছে। শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন জোট চেয়েছে বলেই ইভিএম চালু করতে হবে কেন? এর মাধ্যমে ইসি তার গ্রহণযোগ্যতা হারাল,” বলেন তিনি।
সাখাওয়াত প্রশ্ন তোলেন, “দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, সরকার নিজেই এই কথা বলছে। এই অবস্থায় ইসি কেন এমন প্রকল্প পাস করার জন্য পাঠাল?”