নরসিংদীতে ইউপি নির্বাচন: সরকারি দলের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ৪
2021.11.04
ঢাকা
নরসিংদী সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়ন পরিষদের আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারি দলের স্থানীয় দুই পক্ষের সংঘর্ষে চারজন নিহত ও আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। এ সময় বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
উপজেলার মেঘনা নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নের নেকজানপুর গ্রামে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
“ঘটনাটি ভোরের দিকে দুর্গম চরাঞ্চলে ঘটেছে। সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই সংঘর্ষে মারা গেছেন তিনজন। আহত আরেকজন হাসপাতালে যাওয়ার পথে মারা গেছেন,” বেনারকে বলেন নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান।
তবে এই রক্তক্ষয়ের জন্য পুলিশের অবহেলাকে দায়ী করে আলোকবালী ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুন হাসান বেনারকে বলেছেন, “এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তা আগে থেকে বোঝা যাচ্ছিল। পুলিশকেও জানানো হয়েছিল, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”
নিহতরা হলেন; নেকজানপুর গ্রামের কটুমিয়ার ছেলে আমির হোসেন (৪৫), একই গ্রামের আবদুল জলিলের ছেলে আশ্রাফুল (২২), আব্দুল মনু মিয়ার মেয়ে খুশি বেগম (৫০) ও অজ্ঞাতনামা আরও একজন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আলোকবালী ইউপির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপুর সমর্থক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ আসাদের সমর্থকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে ১০ দিন আগে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছিল। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে লিপ্ত ছিলেন দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থক দুইজন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান দীপু। আসাদ দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। পরে দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ নিয়ে অ্যাডভোকেট আসাদের সমর্থকদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ ও উত্তেজনা চলছিল।
এ অবস্থায় আসাদুল্লাহ সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থী রিপন মোল্লা ও দীপু সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থী আবু খায়ের নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব মাঠ পর্যায়ে দুই কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর সমর্থকদের লড়াইয়ের রূপ নেয়। এরই জেরে বৃহস্পতিবার সকালে টেঁটা-বল্লম ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে দুই পক্ষ।
আত্মঘাতী সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ
এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। ফলে চেয়ারম্যান পদে দলীয় পরিচয়ে তাদের নেতাকর্মীরা মাঠে নেই। এ অবস্থায় অধিকাংশ জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়েছে আওয়ামী লীগ। ইউপি সদস্যপদে দলীয় প্রতীক না থাকলেও আধিপত্য রক্ষায় মারমুখী লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ফলে প্রতিনিয়ত সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। করোনাকালেই প্রথম ধাপের ইউপি ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
বৃহস্পতিবার দৈনিক সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ভোটে আওয়ামী লীগের অন্তত ৩৮ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার নিহত ৪ জন যুক্ত হওয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা এই সংখ্যা এখন ৪২ এ দাঁড়ালো।
“গতবারের ইউপি নির্বাচনের সময় সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল,” উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “এত নির্বাচন নয়, রাজনৈতিক প্রণোদনায় বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ।”
তিনি বলেন, “যারা পদপদবী পায়, তারা বিভিন্নরকম সুযোগ-সুবিধা পায়। তার জন্য প্রবল যুদ্ধ। তাছাড়া নির্বাচন কোথায়? নির্বাচন নেই। একতরফা নির্বাচন হচ্ছে। যেই ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাবে সেই নির্বাচিত হবে- এমন একটা অবস্থা। এই অবস্থায় একপক্ষ আরেক পক্ষকে মাঠছাড়া করতে পারলেই সুবিধা।”
দায় কার?
নির্বাচনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক দলের অসহযোগিতার কারণে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে।
বিদ্যমান পরিস্থি সামাল দেওয়ার জন্য বৃহস্পতিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। সহিংসতা কমাতে বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সভায় বলেন, “প্রথম ধাপের নির্বাচন ভালো হয়েছে। কিন্তু এরপর যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে তার কারণে কমিশন উদ্বিগ্ন।”
দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউপি নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউনিয়নে ১১ নভেম্বর এবং তৃতীয় ধাপের এক হাজার ৭টি ইউনিয়নে ২৮ নভেম্বর ভোট নেওয়া হবে।
প্রথম ধাপে ২১ জুন ২০৪টি ইউপি ও ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০টি ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
“নির্বাচন নিয়ে অরাজক পরিস্থিতি চলছে,” জানান সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বেনারকে তিনি বলেছেন, “ব্যর্থতার দায় নিয়ে এই নির্বাচন কমিশনের আগেই পদত্যাগ করা উচিত ছিল।”
“আইনে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেওয়ার পরও বিগত পাঁচ বছরে ইসি কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি। এতে অন্যায় ও অনিয়ম উৎসাহিত হয়েছে,” বলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার।