রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল, বেশিরভাগই স্বতন্ত্র

অয়ন আমান
2023.12.05
ঢাকা
রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল, বেশিরভাগই স্বতন্ত্র দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকার আগারগাঁও নির্বাচন কমিশন ভবন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবার জন্য ব্যালট বাকশো গাড়িতে ওঠানো হচ্ছে। ২৫ অক্টোবর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভুক্তভোগী এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে।

তাঁদের মতে, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে এক শতাংশ ভোটারের নাম সমর্থক হিসেবে জমা দেওয়ার বিধান থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নই বেশি বাতিল হয়েছে, যা সরকার মনোনীত বেশ কিছু প্রার্থীর বিজয় সহজ করবে।

বাদ পড়া তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে বেনার কথা বলেছে যাদের অভিযোগ, কৌশলে তাঁদের এক শতাংশের গ্যাঁড়াকলে ফেলা হয়েছে।

তবে নির্বাচন কমিশন বলেছে, দৈবচয়ন পদ্ধতিতে এক শতাংশ ভোটারের তালিকা যাচাই করা হয়েছে এবং যাদের ত্রুটি পাওয়া গেছে তাঁদেরই মনোনয়নই বাতিল হয়েছে।

মনোনয়নপত্র বাতিলের তিনটি কারণ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

“স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এক শতাংশ স্বাক্ষর সংক্রান্ত জটিলতা, ঋণ-বিল খেলাপি ও দ্বৈত নাগরিকত্ব,” সাংবাদিকদের জানান ইসির যুগ্ম সচিব (আইন) মো. মাহবুবার রহমান।

নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী, ৫ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রার্থীরা আপিল আবেদন করতে পারবেন এবং ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশন আপিল নিষ্পত্তি করবে।

মনোনয়নপত্রের বৈধতা ফিরে পেতে প্রথম দিনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে আপিল বুথে মোট ৪২টি আবেদন জমা পড়েছে।

ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ফিরোজুর রহমান। তিনি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

ফিরোজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমার একজন সমর্থনকারীকে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের লোকজন অপহরণ করে নিয়ে গেছেন। বলা হচ্ছে, সমর্থনকারী ছেলের পক্ষে তাঁর মা স্বাক্ষর করেছেন। এই একজনের স্বাক্ষরে মিল না থাকায় আমার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “ভোটার মীর বাইজিদ হোসাইন স্বাক্ষর করেছেন বলে ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছেন। তাঁর মা বলেছেন, ‘আমার ছেলে স্বাক্ষর করেছে’।”

মনোনয়ন বাতিলের বিপক্ষে আপিল করবেন বলে জানান ফিরোজুর রহমান।

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যাকে অপহরণের অভিযোগ করা হয়েছে সে তো ডিসির সঙ্গে কথা বলেছে, এসপির সঙ্গে কথা বলেছে, ওসির সঙ্গে কথা বলেছে। আর স্বাক্ষর যদি সঠিক থাকে তাহলে উনি আপিল করে সেটা প্রমাণ করুক।”

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, নির্বাচনী আসন ভেদে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার ভোটারের সাক্ষর প্রয়োজন হয়।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর থাকার বিধান চ্যালেঞ্জ করে মঙ্গলবার হাইকোর্টে রিট হয়েছে। বুধবার হাইকোর্ট বেঞ্চে আবেদনটি উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন রিট আবেদন করা আইনজীবী ইউসুফ আলী।

তিনি বলেন, সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এই বিধানটা তুলে দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ঝামেলামুক্ত ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনে ত্রুটি থাকায় নেত্রকোণা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। তিনি বেনারকে বলেন, “ভোটারদের এক শতাংশের একটি তালিকা আমরা পেশ করেছিলাম। আমাদের এখানে যত ভোটার, তার এক শতাংশের চেয়ে অন্তত ১০০ জনের নাম বেশি ছিল।”

“দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সেই তালিকায় ত্রুটি পাওয়ায় মনোনয়নপত্র বাতিলের কথা বলা হয়েছে। আমার কাছে এটি খুবই হাস্যকর মনে হলো। আমি আপিল করছি, আমি নিশ্চিত যে, আপিলে জয় লাভ করব,” বলেন তিনি।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “যাচাই-বাছাইয়ের আগের দিন বিকেলেই জানাজানি হয়ে গেলো যে, আমার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাবে। আমি আমার আইনজীবীর পরামর্শে এটা প্রশাসনকে জানিয়েছি। তাঁরা একটু অবাক হলেন, কারণ তখনো বাছাই হয়নি।”

“এই যে আগেভাগেই অন্যরা জেনে ফেলে, তাতে মনে হয় এখানে যেকোনো কারসাজি সম্ভব। আমি কারসাজির ব্যাপারটা অনুমান করে বলছি, কারণ এটা আগেভাগেই পাবলিক জানে,” যোগ করেন তিনি।

নব্বইয়ের গণআন্দোলনের ছাত্রনেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শফি আহমেদ বেনারকে বলেন, “প্রথম কথা হচ্ছে এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি ধারা যেটি এক-এগারোর সরকার জারি করেছিল। সাড়ে তিন হাজার ভোটার যদি আমাকে সমর্থন করে তাহলে তো বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলো। এটা মৌলিক অধিকার এবং নির্বাচনী বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”

“আমাকে বলা হয়েছে সমর্থনকারীদের মধ্যে ২ জনের স্বাক্ষর মেলেনি এবং ২ জনকে পাওয়া যায়নি। কার স্বাক্ষর মেলেনি এবং কাকে পাওয়া যায়নি সেটা তো আমরা জানি না। কমিশন জানালে আমরা সমর্থনকারীদের হাজির করব। সেক্ষেত্রে এটা একটা কূটকৌশল ছাড়া আর কিছু নয়,” বলেন তিনি।

মনোনয়ন বাতিল হওয়া প্রার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে নির্বাচন কমিশনের তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। 

30a951a4-eade-40b8-b2c6-ba9eabb15899.jpg
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নেবার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসে প্রার্থী ও সমর্থকদের ভিড়। ১৮ নভেম্বর ২০২৩। [বেনারনিউজ]

মনোনয়ন নিয়ে যা হচ্ছে তা ‘অস্বাভাবিক’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “পুরো বিষয়টি নিয়ে আমি কনফিউজড। তবে সিস্টেমেটিক্যালি এটা করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।”

মনোনয়ন নিয়ে যা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজকে এ দাঁড়ালো, কাল সে নাই শুনলাম, পরশুদিন শুনি সে-ও মনোনয়নপত্র সাবমিট করেছে-তাই আমি নিজেও কনফিউজড।”

নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, “অবৈধ সরকারের গৃহপালিত নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রার্থী বাছাই করে দিচ্ছে। কোন আসনে কে নির্বাচন করবে তাও ঠিক করে দিচ্ছে কমিশন। সেখানে যাকে রাখার দরকার, তাকে রেখে বাকিদের মনোনয়ন বাতিল করছে।”

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২২.৬৮ শতাংশ, ২০০১ সালের নির্বাচনে ৪.৩৭ শতাংশ, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৩.৬৫ শতাংশ এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১.৪৫ শতাংশ মনোনয়ন বাতিল হয়েছিল।

তবে বর্তমান সরকারের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে যথাক্রমে ২০.৭৮ শতাংশ এবং ২৫.৬৪ শতাংশ মনোনয়ন বাতিল হয়।

“আগের দুটির মতো এবারের নির্বাচনও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নয়, পুরোটাই সাজানো নির্বাচনে। তাই যে কোনো কিছুই হতে পারে,” এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। 

আওয়ামী লীগের ৫ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার বলেছেন, আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে, তাঁরা আপিলে না টিকলে দল কোনো পক্ষপাত করবে না।

গত ২৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া-২ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন বাকি রেখে দলীয় মনোনীত ২৯৮ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মোট দুই হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ৭৩১ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। অর্থাৎ বাছাই পর্বে আটকে গেছেন ২৬ দশমিক ৯১ শতাংশ প্রার্থী। মোট বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৯৮৫।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।