ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে লোডশেডিং
2022.07.05
ঢাকা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়া লোডশেডিং ফিরে এসেছে। সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বেশি দামে তরল গ্যাস (এলএনজি) কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে রাজধানীসহ দেশজুড়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, দিনে গড়ে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তাই গত রোববার থেকে সারা দেশে লোডশেডিং বাড়ানো হয়েছে।
দেশে প্রকৃত চাহিদার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বেশি উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও জনগণকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ দিতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে একটি বড়ো সময়জুড়ে বিদ্যুৎ থাকছে না। গরমে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার দেশবাসীকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্ন হওয়ায় জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, “গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে।”
“যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি,” বলেন নসরুল হামিদ।
‘চাহিদার সাথে সরবরাহের পার্থক্য বাড়ছে’
বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে। এই গ্যাসের চাহিদা দেশের অভ্যন্তরীণ কূপ এবং বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়ে থাকে।
দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এর বিপরীতে দৈনিক সর্বোচ্চ প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদুৎ উৎপাদন হয় বলে বেনারকে জানান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন।
তিনি বলেন, ২৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক। বাকি বিদ্যুৎ আসে নবায়নযোগ্য উৎসসহ কয়লা, ডিজেল, ফার্নেস ওয়েলসহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।
“দৈনিক মোট বিদ্যুৎ চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। যদি আমরা দৈনিক ১৩০০ এমএমসিএফ গ্যাস পেতাম তাহলে দৈনিক সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো। বর্তমানে দৈনিক ৮৫০ এমএমসিএফ গ্যাস পাচ্ছি, যা দিয়ে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। ফলে চাহিদার সাথে সরবরাহের পার্থক্য বাড়ছে,” বলেন মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, “ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রতি ঘনফুট এলএনজির দাম পাঁচগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে প্রতি ঘনফুট গ্যাস আন্তর্জাতিক বাজারে ৩০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।”
“সরকার যখন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করেছিল তখন হিসাব করা হয়েছিল, এক ঘনফুট এলএনজি গ্যাসের মূল্য হবে সর্বোচ্চ নয় থেকে ১০ ডলার,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন সেটি ৩০ ডলার। এই অবস্থায় উচ্চমূল্যে এলএনজি কেনা সম্ভব নয়।”
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এলএনজি কেনা কমিয়েছে অথবা বন্ধ করেছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ও মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম।
তিনি বলেন, “সকল দেশ বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোর কথা বলছে। আমি মনে করি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় বন্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত।”
স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করার পর সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।
“তবে সরকারের উচিত গ্যাস চুরি বন্ধ করা। প্রতিদিন প্রায় ১৫ কোটি এমএমসিএফডি গ্যাস চুরি হয়। এই চুরি ঠেকানো গেলে কিছুটা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে,” বলেন অধ্যাপক তামিম।
তাঁর মতে, “শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র নিয়মানুযায়ী ব্যবহার করলে লোডশেডিং থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব।”
‘প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না’
গত তিন সপ্তাহ ধরে গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহ এলাকার হাজার হাজার শিল্প, কলকারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা হচ্ছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন।
তিনি বলেন, “গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এটি একটি বড়ো সমস্যা।”
শহরে কলকারখানার পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট বেড়েছে।
নওগাঁ সদর উপজেলার হাসাইগাড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রশীদ খোকন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে বলা যায় দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।”
বাংলাদেশে প্রথম বিদ্যুৎ প্রচলন করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ চালু হয়। তবে সেই সুবিধা সাধারণ মানুষ পায়নি।
১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে শতকরা ১০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করত। সরকারি হিসেবে, ২০০৯ সাল পর্যন্ত শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসে।
২০০৮-০৯ অর্থ বছরে দেশের দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট। সেই সময়ে শহর, গ্রাম নির্বিশেষে দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকত না।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করার পর বিদ্যুৎ সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধি করতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে সরকার।
কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট চালুর মাধ্যমে দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তবে বেড়ে যায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান।
সরকারের পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে এখন বেসরকারি কোম্পানিগুলো বড়ো ভূমিকা রেখে চলেছে। এসেছে বিদেশি বিনিয়োগ।
পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনেছে সরকার।
বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার আহ্বান
মঙ্গলবার বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি’র ভাষণে এ কথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা সেনানিবাসের পিজিআর সদর দপ্তরের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়লা না পাওয়া এবং গ্যাস ও ডিজেলের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী উপাদানের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেখানেও এখন বিদ্যুতের তীব্র সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যবহার কমাতে এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের লোডশেডিং করে বিদ্যুতের ব্যবহার কিছুটা কমানো যায় কি-না চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।