সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন: নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.09.27
ঢাকা
সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন: নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই বাগেরহাটের মোংলা বন্দর পৌরসভায় ৩৫০ একর জমির ওপর দেশের বৃহত্তম এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গড়ে তুলেছে শিল্পগোষ্ঠী ওরিয়ন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এনার্জন রিনিউয়েবলস। ১২ অক্টোবর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

সরকারের পরিকল্পনামতো ২০৪১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

চার সদস্যের সাব-কমিটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমান সময় পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভাগ যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে ২০৪১ সালের মধ্যে নেপাল, ভুটান থেকে আমদানিসহ ২৪ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা সম্ভব। বাকি নয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কীভাবে আসবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।

বুধবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় গৃহীত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৪ বছরে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।

চলতি মেয়াদের সংসদে প্রথমবারের মতো কোনো স্থায়ী কমিটি সরকারের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পর্কে নীতির সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করল।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

অধিকাংশ প্রকল্প ও পরিকল্পনা ভবিষ্যতে বাস্তবায়নাধীন

বেনারের হাতে আসা সংসদীয় সাব-কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৭ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট। ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গত ১৪ বছরে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র এক হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে উৎপাদন বা আমদানির মাধ্যমে অবশিষ্ট ২২ হাজার ৮০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রাপ্তি কতটা বাস্তবসম্মত তা বিবেচ্য।

এছাড়া ছাড়া ২৪ হাজার মেগাওয়াটের অবশিষ্ট নয় হাজার ৩০৭ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা রূপরেখায় প্রতিফলিত হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, পরিপূর্ণ রূপরেখার অবর্তমানে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক কিছু প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম চললেও অধিকাংশ প্রকল্প ও পরিকল্পনা ভবিষ্যতে বাস্তবায়নাধীন।

বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চলমান, প্রক্রিয়াধীন এবং পরিকল্পনাধীন প্রকল্পের সংখ্যা ১০৯টি। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চলমান প্রকল্পের সংখ্যা মাত্র ৩০টি, বলা হয় প্রতিবেদনে।

সমস্যা চিহ্নিত, সমাধানে সহায়তা করবে কমিটি

এ বছরের ২৩ মে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের সাব-কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের জন্য সঠিক রূপরেখা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ ও দূরীকরণে করণীয় বিষয় সম্পর্কে সুপারিশ করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় সাব-কমিটিকে।

মঙ্গলবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয় বলে বুধবার বেনারকে জানান সাব-কমিটির আহ্বায়ক মো. আবু জাহির।

প্রতিবেদনটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় গৃহীত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি এখন “বর্তমানে মূল কমিটির সুপারিশ হিসেবে বিবেচিত হবে।”

“আমরা সমস্যা চিহ্নিত করেছি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর উদ্দেশ্য হলো, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো “কী সমস্যার মুখোমুখি; সেগুলো বের করে সমাধানে সহায়তা করা।”

লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে

এদিকে সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বুধবার বেনারকে বলেন, স্থায়ী কমিটি যা বলেছে তা “পুরোপুরি সঠিক নয়।”

তিনি বলেন, “আমাদের বর্তমান লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে সংস্থান করা। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আসা বিদ্যুতও অন্তর্ভুক্ত।”

“২০৪১ সালে অনেক দেরি আছে, এর মধ্যে আমরা আরও প্রকল্প গ্রহণ করতে পারব। আমরা আশাবাদী যে, ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে,” বলেন মোহাম্মদ হোসাইন।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা করতে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ডিজেল, ফার্নেস ওয়েল, গ্যাস থেকে নবায়নযোগ্য উৎসে রূপান্তরের নীতি ঘোষণা করেছে সরকার। নবায়নযোগ্য উৎসের মধ্যে রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ু চালিত বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাসসহ অন্যান্য উৎস।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নবায়নযোগ্য উৎসের মধ্যে বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুতের সম্ভাবনা বেশি হলেও এর জন্য প্রচুর জমি প্রয়োজন হয়। সরকারি হিসেবে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিন একর জমি দরকার, যা বাংলাদেশের মতো ভূমি সংকটের দেশে খুবই কঠিন।

২০৪১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করতে গেলে সরকারকে “এখন থেকেই সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে,” বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ সৌর ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সমিতির সভাপতি নুরুল আখতার।

তিনি বলেন, “নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে, তবে সেটি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক কর্মপরিকল্পনা নেই। সে কারণেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না।”

“আমাদের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হলো, রুফটপ সোলার সিস্টেম। সরকার যদি নীতি সম্পর্কিত সহায়তা প্রদান করে, সে ক্ষেত্রে দ্রুতই নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে,” বলেন নুরুল আখতার।

তবে তাঁর মতে, “নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে আলাদা করে ভিন্ন বিভাগ করতে হবে। অন্যথায় এই খাতে উন্নয়ন খুব কঠিন।”

উল্লেখ্য,নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা রিনিউয়েবল এনার্জি হলো এমন শক্তির উৎস যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং এর ফলে শক্তির উৎসটি নিঃশেষ হয় না।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমন: সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈব শক্তি ( বায়োগ্যাস, বায়োম্যাস, বায়োফুয়েল), ভূ -তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

জলবায়ু ও সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।