পাঁচ বছর পর মুক্তি পেয়ে বললেন মাইকেল চাকমা ‘আয়নাঘর যেন কবর’

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.08.09
ঢাকা
পাঁচ বছর পর মুক্তি পেয়ে বললেন মাইকেল চাকমা ‘আয়নাঘর যেন কবর’ মাইকেল চাকমাকে উঠিয়ে নেবার পর তাঁর সন্ধান চেয়ে পরিবার সদস্য ও স্বজনদের সংবাদ সম্মেলন। ২০ এপ্রিল ২০১৯।
[এএফপি]

“আয়নাঘর যেন একটি কবর, সেখানে আমরা যাঁরা থেকেছি তাঁরা ছিলাম ‘জিন্দা লাশ’।  ওখানে থাকার চেয়ে মৃত্যু বরং ভালো।”

বেনারনিউজের কাছে শুক্রবার এমন মন্তব্য করেছেন সাড়ে পাঁচ বছর পর আয়নাঘর নামে সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তর (ডিজিএফআই) পরিচালিত গোপন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া মাইকেল চাকমা (৪৫)।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি মিলেছে মাইকেল চাকমার মতো বেশ কয়েকজন ব্যক্তির, যাঁরা বন্দি অবস্থায় বছরের পর বছর বাইরের আলো-বাতাস দেখেননি, কোনো শব্দ শোনেননি। 

মাইকেল ছাড়াও মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নেতা গোলাম আযমের পুত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ হিল আমান আযমী, একই দলের নেতা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া মীর কাশেম আলীর ছেলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) বিজ্ঞপ্তিতে গত বুধবার বলা হয়, ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা থেকে সাংগঠনিক কাজ শেষে ঢাকায় ফেরার পথে রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক মাইকেল চাকমা গুমের শিকার হন।  এর পর থেকে তাঁর কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।

এতে আরো বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দিন ৬ আগস্ট ভোরে ডিজিএফআই’র ‘আয়নাঘর’ থেকে বের করে চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার একটি জঙ্গলে হাত ও চোখ বেঁধে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়।

“আটকের দিনও আমাকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে ফেলে হয়েছিল।  ঘন্টাখানেক গাড়ি চলার পর ডিজিএফআই নিয়ন্ত্রিত একটি ভবনে নিয়ে আমাকে আটকে রাখা হয়,” বলেন মাইকেল।

সোয়া পাঁচ বছর তাঁকে মোট আটটি বিভিন্ন আকৃতির ঘরে আটক রাখা হয়।  ঘরগুলোর চার কোনায় চারটি টেবিল ফ্যান চলত এবং ঘরের কাঠের দরজা বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হতো। আবার যে ভবনে কক্ষগুলো ছিল সেই ভবনের উপরের দিকে ছিল বিরাট এক্সহস্ট ফ্যান যেগুলো জোরে শব্দ করত।

মাইকেল চাকমা বলেন, “এগুলো করার উদ্দেশ্য হলো ভিতরের কোনো শব্দ যাতে বাইরে না যায় এবং বাইরের শব্দ যেন ভিতরে প্রবেশ না করে।  ঘরগুলোতে আলো ছিল না বললেই চলে।”

তিনি বলেন, “খাবারের সময় সেখানকার সুপারভাইজাররা দরজা খুলে খাবার দিয়ে যেত এবং কোনো কথা বলত না। খাবারের মান ছিল খুব খারাপ, এত পরিমাণ মরিচের গুঁড়া দিত যে মুখে দেওয়ার সাথে সাথে মুখ পুড়ে যেত।  বুক-পেট জ্বালা করত।  কখনও কখনও বাসি খাবারও দেওয়া হতো। অসুস্থ হলে আবার ডাক্তারও আসত।”

মাইকেল চাকমা বলেন, “টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন হলে দরজায় গিয়ে টোকা দিলে সুপারভাইজাররা এসে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে টয়লেটে নিয়ে যেতো। টয়লেটের দরজায় একটি ছিদ্র ছিল সেটি দিয়ে তারা ভেতরে দেখত।   টয়লেট ব্যবহার শেষ হলে চোখ বাঁধা অবস্থায় আবার হাতকড়া পরিয়ে কক্ষে এনে তা খুলে দেওয়া হতো।”

তিনি বলেন, “তারা আমাকে কয়েকবার শারীরিক নির্যাতন করেছে।  কয়েকজনের ওপর চরম শারীরিক নির্যাতন হয়েছে। তাদের সাধারণ কৌশল হলো, বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা।”

‘মনে করিনি আমি আর বাঁচব’

মাইকেল চাকমা বলেন, “আমি ওই ঘরগুলোকে বলেছি  ‘কবর’। এখানকার মানুষগুলো যেন ‘‌জি‌ন্দা লাশ’। আমাকে ছেড়ে দেওয়ার তিন বছর আগে কোনও মানুষের সাথে আমার কথা হয়নি।  আমি কখনও মনে করিনি যে, আমি আর বাঁচব।”

তিনি বলেন, “একদিন তাদের একজন এসে বলছিলেন, ‘আমরা যদি তোমাকে ৩০ বছরও আটকে রাখি দুনিয়ার কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না।  তুমি যে বেঁচে আছ সেটিই তোমার ভাগ্য’।”

মাইকেল চাকমা বলেন, “আমি তাকে সাথে সাথে বলেছি, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।  গুলি করেন বলে বুক পেতে দিয়েছি। এরপর সে চলে গেছে। কোনো কথা বলেনি।”

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে প্রচুর মানুষকে ধরে আনা হয়।  তখন জায়গা না পেয়ে রংপুরের মমিনপুর এলাকার বাসিন্দা এবং জাতীয় পার্টির এক নেতার গাড়ি চালক খায়রুলকে ধরে আমার কক্ষে রাখা হয়।  ওই নেতার সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল।  এটিই ছিল তাঁর অপরাধ।”

মাইকেল চাকমা বলেন, “ওই বছর প্রচুর শীত পড়েছিল। সেকারণে ফ্যানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।  তখন চারিদিকে নির্জন পরিবেশে আমি পাশের কক্ষগুলো থেকে অনেকের কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম।”

তিনি বলেন, “সেখানে না থাকলে বুঝতে পারবেন না যে সেই পরিবেশ কতটুকু অসহনীয়।  ওখানে থাকার চেয়ে মৃত্যু ভালো।”

IMG_5278.jpg
মাইকেল চাকমা। তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেয়া ছবি।

জানি না কোন অপরাধে ধরে নেওয়া হয়েছিল

মাইকেল বলেন, “এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যখন নিয়ে যাওয়া হতো, তখন চোখ শক্ত করে বেঁধে মাথায় টুপি দিয়ে চোখ ঢেকে তার ওপর আরেকটি আবরণ দেওয়া হতো।  হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হতো।”

তিনি বলেন, “আবার সেখানকার সুপারভাইজাররা সবাই বড় মাস্ক অথবা মুখোশ পরে থাকতো।  এই মুখোশগুলো দেখলে আপনি ভীত হয়ে যাবেন।  তাদের উদ্দেশ্য আপনাকে আতঙ্কিত করে রাখা।”

মাইকেল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের সব জাতিসত্তার জনগণ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।  তিনি ছিলেন ইউপিডিএফ-এর অন্যতম সংগঠক।

এক প্রশ্নের জবাবে মাইকেল বলেন, “‌আমি এখনও জানি না, কেন, কোন অপরাধে ধরে নেওয়া হয়েছিল।  আমার কাছে বারবার অস্ত্রের সন্ধান জানতে চাওয়া হয়।  আমার বিরুদ্ধে থানায় মামলা আছে বলেও জানানো হয়। ”

‘আয়নাঘরে’ কতজন আটক রয়েছেন, সেব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকার অথবা ডিজিএফআই’র পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম-খুনের শিকার পরিবারের সদস্যদের প্ল্যাটফরম ‘মায়ের ডাক’ সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম শুক্রবার বেনারকে বলেন, তিনি এবং তাঁর সংগঠনের সদস্যরা সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ডিজিএফআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল হামিদের সাথে দেখা করে নিখোঁজ সদস্যদের ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাঁর ভাই ও শাহীনবাগ এলাকার বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম সুমনকে উঠিয়ে নিয়ে যায় র‌্যাব।  এরপর থেকে সুমনের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সানজিদা ইসলাম বেনারকে বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে বছরের পর বছর ধরে ডিজিএফআই নির্যাতন সেল ‘আয়নাঘর’ এ আটক কয়েকজন মুক্তি পেয়েছেন।  কিন্তু আরও অনেক ব্যক্তি আটক আছেন বলে আমরা মনে করি।”

তিনি বলেন, “ডিজিএফআই সদর দপ্তরের কাছের ‘আয়নাঘর’ থেকে কয়েকজনের মুক্তি মিলেছে।  কিন্তু সারাদেশে এরকম অনেক ‘আয়নাঘর’ রয়েছে যেখানে এখনও অনেক ব্যক্তি আটক রয়েছেন।  আমরা চাই অবিলম্বে এইসব গোপন বন্দীশালা বন্ধ করে আটকদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ফেরত দিতে হবে।”

সানজিদা ইসলাম বলেন, “শনিবার আবার আমরা সেনাপ্রধানের সাথে দেখা করে এব্যাপারে আমাদের অবস্থান জানাব।  একটি স্বাধীন ও সভ্য দেশে এমন গোপন কারাগার থাকতে পারে না।”

নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ-খবর জানতে গত ৬ আগস্ট মিরপুর-১৪ নম্বরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবস্থিত ডিজিএফআই’র প্রধান কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেছিলেন তাদের স্বজনরা। 

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) ‘আয়নাঘরের বন্দীদের’ সবাইকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তারা।  গত মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।