বায়ু দূষণ প্রতিরোধে ৭৩ হাজার বাস-ট্রাক প্রত্যাহারের উদ্যোগ
2024.04.09
ঢাকা
ঢাকাসহ সারা দেশে ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণ ঠেকাতে ৭৩ হাজারের বেশি বাস-ট্রাক প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
যেসব বাস-মিনিবাস ২০ বছরের বেশি এবং ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান ২৫ বছরের বেশি পুরোনো সেগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরোনো এসব যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও দূষিত পদার্থ দেশে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া এসব যানবাহন রাস্তা থেকে সরিয়ে নেওয়া হলে বায়ুমানের উন্নতি ঘটবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রথমবারের মতো এ ধরনের যানবাহনের তালিকা প্রস্তুত করে সোমবার পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেই তালিকার একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
তালিকা অনুসারে, সারা দেশে ২৫ বছরের বেশি পুরাতন ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকার রয়েছে মোট ৩৭ হাজার ৮৮৬টি। ২০ বছরের বেশি ও ২৫ বছরের কম বয়সী যানবাহনের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৮২টি।
এই শ্রেণিগুলোতে বাংলাদেশে মোট পরিবহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লাখ। সে অনুযায়ী শতকরা ১৬ ভাগের বেশ পরিবহন প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মন্ত্রিসভায় সাবের হোসেন চৌধুরী পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার নেওয়া অগ্রাধিকার কর্মসূচির মধ্যে একটি ছিল যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধ করা ও বায়ু দূষণ রোধে ব্যবস্থা নেওয়া।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে গত ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় মত বিনিময় সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ৮ এপ্রিলের মধ্যে আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া যানবাহনের তালিকা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে সরবরাহ করবে বিআরটিএ।
সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, ওই তালিকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি এবং ঢাকা পরিবহন সমিতি যাচাই-বাছাই করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে জানাবে।
কবে নাগাদ এসব পুরাতন যানবাহন রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হবে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বিআরটিএর জমা দেয়া তালিকা পরিবহন সমিতিগুলো যাচাই-বাছাই করার পর আমরা মালিকদের পুরাতন যানবাহনগুলো সরিয়ে নিতে “তিন থেকে পাঁচ মাস সময়” নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
“এই সময়ের মধ্যে তাঁরা প্রত্যাহার না করলে এই যানবাহনে নম্বরসহ তালিকা পুলিশকে পাঠিয়ে দেবো। পুলিশ সেগুলো আটক করবে এবং যানবাহনগুলো ভেঙে ফেলা হবে,” বলেন তিনি।
এই উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকাসহ সারা দেশে বায়ুমানের উন্নয়ন ঘটবে এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও জানান তিনি।
বিভিন্ন গবেষণার উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বায়ু দূষণের কারণে ২০১৯ সালে স্বাস্থ্যগত ব্যয় ছিল দেশের মোট জিডিপির প্রায় শতকরা আট শতাংশ।”
বায়ু দূষণে যানবাহন কতটা দায়ী?
যানবাহনের কালো ধোঁয়াসহ বিভিন্ন দূষণকারী পদার্থ নির্গমনের ফলে সেগুলো কতটুকু বায়ুমানের অবনতি ঘটায় তা নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে।
ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের ওপর ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে।
সেই সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা মহানগরী ও বৃহত্তর ঢাকা জেলায় বায়ু দূষণে গৃহস্থালি কাজে পোড়ানো বায়োমাস শতকরা ২৮ শতাংশ দায়ী। এছাড়া তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২৪ শতাংশ, ইটভাটা ১৩ শতাংশ, অতিসূক্ষ্ম ধুলা ও রাস্তার ধুলা ১৩ শতাংশ, বিভিন্ন কঠিন বর্জ্য পোড়ানো ১১ শতাংশ ও পরিবহন শতকরা ছয় শতাংশ দায়ী।
তবে সরকার ও বেসরকারি গবেষকরা এই গবেষণাকে সঠিক বলে মনে করেন না।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বেনারকে বলেন, “যানবাহন থেকে দূষণের মাত্রা এত কম সেটি আমরা মনে করি না। ঢাকায় যানবাহনের কালো ধোঁয়া একটি বড়ো সমস্যা। কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ দূষণ হয় সেটি আরও ভালোভাবে জানতে আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা একটি আলাদা গবেষণা করব।”
বায়ু দূষণ নিয়ে গত ২০ বছর ধরে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তিনিও বিশ্বব্যাংকের গবেষণা নিয়ে আপত্তি তুলে বলেছেন, ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিবহন খাত।
তিনি বেনারকে বলেন, “গত ২০ বছর আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি, ঢাকায় বিভিন্ন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়ানোর কারণে দূষণের পরিমাণ শতকরা ৪৬ শতাংশ। আর এই জ্বালানি পোড়ানোর প্রধান খাত বলা যায় পরিবহন খাত।”
সালাম বলেন, “এই ৪৬ শতাংশের মধ্যে পরিবহন খাত কমপক্ষে ৩০ ভাগ দূষণ করে থাকে। এক কথায়, পরিবহন খাত হলো দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। এই খাতে দূষণ কমানো গেলে ঢাকাসহ সারা দেশে বায়ু দূষণ তাৎপর্য্যপূর্ণভাবে কমে আসবে।”
কীভাবে একটি পুরাতন যান বেশি বায়ু দূষণ করে—ব্যাখ্যা করে সালাম বলেন, “একটি নতুন গাড়ি কিনে চালালেও সেটি বায়ু দূষণ করবে। তবে সেটির মাত্রা অনেক কম থাকবে। কারণ নতুন ইঞ্জিন জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই পুড়িয়ে ফেলতে পারে। গাড়ির বয়স যত বাড়বে, দূষণের মাত্রা তত বাড়বে। বয়স বৃদ্ধির কারণে মানুষ যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে, গাড়ির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।”
তিনি বলেন, “পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিন জ্বালানি তেলের পুরোটা পুড়িয়ে ফেলতে পারে না; আংশিক পারে। ইঞ্জিনে যাওয়া জ্বালানি তেলের একটি অংশ ধোঁয়ার মাধ্যমে বাতাসে চলে আসে, ফলে বাতাস দূষিত হয়।”
সালাম বলেন, “পরিবেশ মন্ত্রণালয় যে উদ্যোগ নিয়েছে, এটি অনেক পুরাতন সিদ্ধান্ত ছিল। বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকাসহ সারা দেশে এসব পুরাতন যানবাহন অবাধে চলছে।
“আমি মনে করি, সরকার দেরিতে হলেও পুরাতন যানবাহনের তালিকা তৈরি করে ভালো করেছে। এখন সময় নষ্ট না করে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন দরকার।”
‘পুরাতন যানবাহন মূল সমস্যা না’
বায়ু দূষণ সম্পর্কে ভিন্ন মত পরিবহন শ্রমিকদের। ঢাকার মিরপুর-১২ থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলা বিকল্প অটো সার্ভিসের চালক আরিফ হোসেন বেনারকে বলেন, “আমি ২০ বছর ধরে পরিবহন খাতে যুক্ত আছি। গাড়ি চালাই, গাড়ি মেরামত তদারকি করি। আমি বলতে পারি যে, গাড়ি পুরাতন হলে সমস্যা বাড়ে সেটি ঠিক, কিন্তু পুরাতন গাড়িই মূল সমস্যা না।
“মূল সমস্যা হলো, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এবং ভেজাল তেল-মবিল। একটি গাড়ি যত পুরাতন হোক না কেন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বের হবে না। আমাদের গাড়ির মালিকরা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করেন না, তাই দূষণ বাড়ে।”
আরিফ বলেন, “মালিকরা ৪০০ টাকা লিটারের মবিল (লুব্রিকেটিং ওয়েল) ব্যবহার না করে ২০০ টাকা দামের ভেজাল মবিল ব্যবহার করেন। এর মধ্যে পোড়া মবিল থাকে, ময়লা থাকে। ফলে দেখা যায়, কালো ধোঁয়া বের হয়। আমরা যে ডিজেল ব্যবহার করি সেটিও ভেজাল, ময়লাযুক্ত। সে কারণেও কালো ধোঁয়া বের হয়।”
তিনি বলেন, “আবার শতকরা ৯০ শতাংশ গাড়ির তেলের ট্যাংক প্রায় অর্ধেক খালি থাকে। ট্যাংক পূর্ণ না থাকলে ডিজেলের ভেতরের ময়লাসহ দ্রুত ইঞ্জিনে যায় এবং কালো ধোঁয়া বের হয়।”