প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন রক্ষায় কাজে আসছে না কোনো আইন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.08.01
ঢাকা
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন রক্ষায় কাজে আসছে না কোনো আইন প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের কাছে পানির তলদেশে খাবার খুঁজছে একটি মাছ। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ছবিটি তুলেছেন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক শরীফ সারওয়ার। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

চব্বিশ বছর আগে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং দেড় বছর আগে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার পরও দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের সৈকত থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাজ কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপসহ বিভিন্ন কোরাল প্রজাতি ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে।

মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পর্যটন ছাড়াও মানুষের অতিরিক্ত চাপ, মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ এবং প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য ফেলার কারণে দ্বীপটির জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর প্রস্তুত করা ওই প্রতিবেদনটি রোববার পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পেশ করা হয়। প্রতিবেদনটির একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।

আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে বিভিন্ন সরকারি ভবন ছাড়াও প্রায় ২০০ অনুমোদনহীন ভবন রয়েছে, যা আইনত অবৈধ।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে শুধু জীব-বৈচিত্র্য নয়, পুরো দ্বীপের অস্তিত্বই হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ হিসাবে তাঁরা বলছেন, অনেকেই এখান থেকে পাথর তুলে থাকে। পাথর তুললে পুরো দ্বীপ এক সময় সাগরে তলিয়ে যাবে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সেন্টমার্টিন আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী অনুমোদন ছাড়া এখানে কোনো ভবন নির্মাণ করা যায় না। কিন্তু আমরা দেখছি, শত শত ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো কীভাবে হচ্ছে? কারা অনুমতি দিচ্ছে? এগুলো বন্ধ করতে হবে। দ্বীপটি যে কোনো মূল্যে হোক রক্ষা করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমাদের সুপারিশ হলো, সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আবর্জনা ফেলা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।”

যা বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে

নারিকেল জিঞ্জিরা নামে এই দ্বীপটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ যা বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত। দ্বীপটিতে প্রায় ১০ হাজার মানুষের বসবাস।

দ্বীপটিকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে এটিকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়।

সেই ঘোষণা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা, সকল প্রকার শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস, ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা, মাছ ও জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু করা, পাথর উত্তোলন, সৈকতে ফানুস উড়ানো, মাইক বাজানো, আতশবাজি, উচ্চস্বরে গান করা এবং প্লাস্টিকসহ সকল প্রকার বর্জ্য ফেলা নিষিদ্ধ।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, অতিরিক্ত মানুষের বসতিসহ উপকূলীয় ক্ষয়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, কোরাল বিস্তৃতিসহ বিভিন্ন ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। মৎস্য আহরণে ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, অপরিকল্পিত পর্যটন, গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও জীব-বৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

একটি জেনারেল হাসপাতাল, একটি পোস্ট অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ভবন, কোস্টগার্ড ভবন, থানা ভবন, লাইটহাউসসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ছাড়াও প্রায় দুই শতাধিক অননুমোদিত হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে সেন্টমার্টিনে। পর্যটন মৌসুমে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটকের অবাধ বিচরণে দ্বীপটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এতে আরও জানানো হয়, ইতোমধ্যে সাগর সৈকত থেকে রাজ কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ, কোরালসহ নানা প্রজাতি হারিয়ে গেছে।

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে সেন্টমার্টিনকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়। তবু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

DSC00412 (2).JPG
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের কাছে পানির তলদেশের পরিবেশ। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ছবিটি তুলেছেন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক শরীফ সারওয়ার। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। [বেনারনিউজ]

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ধারণ ক্ষমতার চেয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর অনেক বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দি কনজারভেশন অব নেচার বাংলাদেশ শাখার প্রধান ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “পর্যটনের কারণে সেখানে হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। পর্যটকদের সেবা দিতে বাড়তি মানুষের দরকার হয়েছে। সেখানে অতিরিক্ত মানুষ গেছে। এই মানুষের জন্য সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “সেন্টমার্টিন দ্বীপে মৎস্য আহরণের সময় জেলেদের জালে কচ্ছপ আটকা পড়লে জাল থেকে ছাড়াতে তারা কচ্ছপগুলোর চার পা কেটে সাগরে ফেলে দেয়। এভাবে কচ্ছপ হারিয়ে গেছে।”

পর্যটক যেভাবে জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস করে উদাহরণ দিয়ে ইশতিয়াক উদ্দিন বলেন, “কচ্ছপ রাতে ডিম পাড়ে। রাতে যখন পর্যটকরা আলো জ্বালায়, আতশবাজি করে, উচ্চ শব্দে গান করে তখন কচ্ছপগুলো ডিম না পেড়ে পেটের মধ্যে রেখে দেয় এবং কিছুদিন পর পেটের মধ্যে ডিম ফেটে মারা যায়।”

“দুঃখের কথা হলো পরিবেশ অধিদপ্তরও সেন্টমার্টিন দ্বীপে একটি অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ করেছিল, যেটা পরবর্তীতে কাজে লাগেনি। সরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য ও অস্তিত্বকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে,” যোগ করেন তিনি।

ইশতিয়াক উদ্দিন বলেন, “আমরা দেখেছি সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। পাথরগুলো দ্বীপটিকে ধরে রেখেছে। পাথর সরিয়ে ফেলা হলে এক সময় পুরো দ্বীপটি সমুদ্রে হারিয়ে যাবে।”

তিনি আরও বলেন, “দ্বীপটিকে রক্ষা করতে হলে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ফেলতে হবে। পর্যটকদের অবস্থান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখতে হবে। অন্যথায় এই দ্বীপকে আমরা রক্ষা করতে পারব না।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা অধিশাখার পরিচালক সৈয়দা মাসুমা খানম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রক্ষার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ এবং দ্বীপটিকে রক্ষার জন্য ২০২৩ সালে একটি নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। এটি বাস্তবায়ন করা হলে দ্বীপটি রক্ষা করা যাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।