ঢাকায় কমছে কাক, নেই গবেষণা-রক্ষার উদ্যোগ
2024.06.14
ঢাকা
প্রকৃতির ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত কাকের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে রাজধানী ঢাকায়। এক দশক আগেও কাকের কর্কশ ডাকে ঘুম ভাঙত রাজধানীবাসীর, কিন্তু এখন সেই ডাক কম শোনা যায়। ময়লার ভাগাড়ের কাছে খাবার নিয়ে কাকের মারামারি নেই বললেই চলে।
কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং আবাসস্থল নষ্ট হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাকের সংখ্যা কমেছে। কোথাও কোথাও এক সঙ্গে অনেক কাকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
রাজধানীর দুয়ারীপাড়ার ভোলা বস্তির বাসিন্দা নাজমা আক্তার বেনারকে বলেন, “কয়েক বছর আগেও আমি মাছ কাটলে কাক এসে পাশে চিৎকার করত। মাছের নাড়িভুঁড়ি দিলে সাথে সাথে খেয়ে ফেলত। এখন আর আসে না। মাছের আঁশ, নাড়িভুঁড়ি খালে ফেলে দেই।”
“কাক এত বেশি ছিল যে, কখনো কখনো বাচ্চাদের হাত থেকে খাবার কেড়ে নিতো,” বলেন নাজমা।
মিরপুর-১২ এলাকায় ফেরি করে মুরগি বিক্রি করেন শহীদুল ইসলাম। তিনি বেনারকে বলেন, “আগে মুরগি জবাই করে নাড়িভুঁড়ি ফেলে দেওয়ার সাথে সাথে কাক এসে নিয়ে যেত। আমাকে বেশি ময়লা টানতে হতো না।”
এদিকে কাক রক্ষার দায়িত্ব বন বিভাগের বন্যপ্রাণী শাখার হলেও ঢাকাসহ সারাদেশে কত সংখ্যক কাক রয়েছে সেব্যাপারে কোনো গবেষণা বা জরিপ নেই বলে বেনারকে জানান বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ।
তিনি বলেন, “অচিরেই আমরা এব্যাপারে গবেষকদের সাথে কথা বলে একটি জরিপ করার চেষ্টা করব।
ঢাকায় কাকের সংখ্যা কমে গেছে স্বীকার করে তিনি বেনারকে বলেন, “কাকের সংখ্যা কমে যাওয়া আমাদের জন্য অশনি সংকেত।”
এ নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “ইঁদুর মারতে বিভিন্ন ধরনের বিষ প্রয়োগ করা হয়। সেগুলো খেয়ে বিষক্রিয়ায় কাকের মৃত্যু হয় কি না জানা দরকার।”
তিনি বলেন, “গবাদি পশুকে ডাইক্লোফেনাক ওষুধ খাওয়ানোর কারণে আমরা শকুন হারিয়েছি। এখন কাকের সংখ্যাও কমছে। বিষয়টি আমাদের কারিগরি কমিটিতে তুলব এবং গবেষণার মাধ্যমে কারণ বের করার উদ্যোগ নেব।”
তবে কাকের সংখ্যা কমার বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক। তিনি বেনারকে বলেন, “ঢাকায় সব স্থানে কাকের সংখ্যা কমেনি। যেমন বনানী এলাকায় কাকের সংখ্যায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। অনেক সময় পাখি এক স্থানে খাবার না পেলে অন্য স্থানে চলে যায়। তেমন ঘটনা ঘটতে পারে।”
উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাকের মৃত্যু
রাজশাহীতে ২০১৬ সালে একসঙ্গে অনেক কাকের মৃত্যু হয়। গাছ থেকে পড়ে কাক মারা যায়। ২০১৮-১৯ সালে যশোরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) মৃত কাকের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইডিসিআর-এর পরিচালক ড. তাহমিনা শিরীন বেনারকে বলেন, “ঢাকার গুলিস্তান, যশোর ও রাজশাহী জেলায় গণহারে কাকের মৃত্যুর পরে নমুনা পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি—অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে কাকগুলোর মৃত্যু হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ময়লার ভাগাড় থেকে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত মৃত মুরগি বা অন্য কোনো প্রাণীর মাংস খেয়ে কাকগুলো সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে। অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের আরেকটি স্থান হলো জ্যান্ত হাঁস-মুরগির বাজার। সেখানে জৈব নিরাপত্তার বিষয়টি একদম মানা হয় না।”
বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জৈব ঝুঁকি। ২০০৭ সালে বার্ড ফ্লু দেখা দেয়। সে সময় খামারে অসংখ্য মুরগি মেরে ফেলা হয়।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে দেখা দেয় অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা। ওই ঘটনার পরে আলোচনায় আসে জৈব নিরাপত্তা।
তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ.ফ.ম. রুহুল হক বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণ হলো পোল্ট্রি খাত। আমাদের পোল্ট্রি খাত বড়ো হয়েছে। সেখান থেকে ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সমস্যা হলো, আমাদের পোল্ট্রি খামারে অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা দেখা দিয়েছে কি না সেটি সব সময় পরীক্ষা করা হয় না। খামারে কোনো মুরগি মারা গেলে সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ও জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নির্ধারিত প্রটোকল অনুযায়ী ফেলে দেওয়া হয় না। এগুলো সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে ডাস্টবিনে ফেলা হয়।”
রুহুল হক বলেন, “আক্রান্ত মৃত মুরগি থেকে অন্যান্য প্রাণী বা পাখির সংক্রমণ খুবই স্বাভাবিক। সে কারণেই কাকের মধ্যে অ্যাভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জার বিস্তার ঘটেছে বলা যায়।”
কাকের বাসস্থান সংকট
বন ও জীববৈচিত্র্য গবেষক ও আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “ঢাকায় আমরা অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করেছি। কোনো খোলা জায়গা নেই, গাছ নেই। গাছের শক্ত ডালে বাসা বাঁধে কাক, গাছ না থাকলে এরা থাকবে কোথায়? বংশ বিস্তার করবে কীভাবে?”
বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক সুজাউল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “ঢাকা মহানগরীর যেসব স্থানে গাছ আছে, যেমন বনানী, রমনা পার্ক অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কিছু কাক দেখা যায়। যেখানে গাছ নেই, সেখানে কাক নেই। তবে সার্বিকভাবে কাকের সংখ্যা কমেছে।”
তিনি বলেন, “ঢাকায় কাক এবং বিভিন্ন পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি বড়ো কারণ হিসেবে বলা হয় মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে বের হওয়া তেজস্ক্রিয়া। পাখিরা তেজস্ক্রিয়া থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। এ ব্যাপারে গবেষণার তাগিদ দেন এই অধ্যাপক।