সরকারের প্রশংসা করা অস্তিত্বহীন লেখকদের নিয়ে সমালোচনার ঝড়

আহম্মদ ফয়েজ
2023.09.08
ঢাকা
সরকারের প্রশংসা করা অস্তিত্বহীন লেখকদের নিয়ে সমালোচনার ঝড় ঢাকার কমলাপুরে দেয়ালে লাগানো সংবাদপত্র পড়ছেন কয়েকজন পাঠক। ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে লেখা নিবন্ধ লেখকদের অনেকেই অস্তিত্বহীন বলে খবর প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।

সরকার এ ধরনের লেখক নিয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করলেও সম্পাদক, সাংবাদিকতার অধ্যাপক ও পাঠকদের অনেকে বলছেন, সরকারই এসব লেখার সুবিধাভোগী।

সাত শতাধিক নিবন্ধ বিশ্লেষণ করে বার্তা সংস্থা এএফপি এসব অস্তিত্বহীন লেখক সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করে, যা বৃহস্পতিবার স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।

সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধের অনেক লেখকেরই হদিস পাওয়া যায়নি। লেখকের নামের সঙ্গে তাঁদের যে ছবি ছাপা হয়েছিল সেগুলোও ভুয়া।

ঢাকা থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমাদের সম্পাদকীয় দল সন্দেহজনক ইমেইল থেকে প্রতিদিনই এই ধরনের নিবন্ধ পাচ্ছে। আমরা সহজেই বুঝতে পারছি সরকারের পক্ষে প্রচারণার জন্য অর্থের বিনিময়ে নিয়োগকৃত একদল লোক এসব নিবন্ধ তৈরি করেছে। অনেক লেখক ভুয়া- এ খবরটি দেখে আমি অবাক হয়েছি।”

এটি সাংবাদিকতার জন্য “বিপজ্জনক” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা (সাংবাদিক) এখন সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্য অন্ধ। এই ঘটনা আমাদের চোখ খুলতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে।”

এশিয়াজুড়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াও এসব ভুয়া লেখকদের নিবন্ধ প্রকাশ করেছিল। পরে তা ওয়াশিংটনভিত্তিক ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক খবরের সংক্ষিপ্তসারেও উদ্ধৃত হয়।

এইসব লেখকদের লেখা নিবন্ধ প্রকাশ করা আঞ্চলিক গণমাধ্যম সিনহুয়া, ব্যাংকক পোস্ট ও এশিয়া টাইমসের সাথে বেনারের পক্ষ থেকে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

_ZOB1353-1.jpg
ঢাকার রাজারবাগ এলাকায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সংবাদপত্র পড়ছেন এক ব্যক্তি। ৩১ জুলাই ২০২৩। [বেনারনিউজ]

লেখকদের ছবিও ভুয়া

এএফপি অন্তত ৬০টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সাইটে ৩৫ জনের নামে প্রকাশিত সাত শতাধিক নিবন্ধ বিশ্লেষণ করেছে, যেগুলোর সবই গত বছর প্রথমবারের মতো অনলাইনে প্রকাশিত হয়।

নিবন্ধগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ছিল কট্টর চীনপন্থি এবং যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনামূলক। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ঢাকাকে কঠোরভাবে সতর্ক করায় ওই সব লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করা হয়।

ওই ৩৫ জন লেখকের মধ্যে অন্তত ১৭ জন তাঁদের নামের সঙ্গে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের কখনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লুসার্ন এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এএফপিকে নিশ্চিত করেছে, কথিত নয় জন লেখক তাদের প্রতিষ্ঠানে কখনো কাজ করেননি।

একজন লেখকের নাম ‘ডরিন চৌধুরী’, যিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে, চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে সমর্থন করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলা ‘মানবাধিকারের জন্য হুমকি’ বলে সতর্ক করে অন্তত ৬০টি নিবন্ধ লিখেছেন।

তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে একজন ভারতীয় অভিনেতার ছবি। তিনি নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাজনীতি বিষয়ক গবেষক বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, ওই নামে কোনো ব্যক্তি সেখানে কাজ করার রেকর্ড তাদের কাছে নেই।

সরকার কোনো লেখক নিয়োগ দেয়নি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সরকারের প্রশংসা করে নিবন্ধ লেখা অস্তিত্বহীন লেখকদের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কোনো নিবন্ধ লেখার জন্য আমরা কোনো লেখককে নিয়োগ দেইনি। আমাদের অর্জন একদম দৃশ্যমান এবং জনগণ সরকারবিরোধী প্রচারণা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। তাই কোনো লেখক নিয়োগের প্রয়োজন হয় না।”

“আমরা কখনো এ বিষয়ে কোনো শাখা খুলিনি এবং আমাদের কোনো লেখক প্যানেল নেই,” বলেন তিনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ফারুক খান বেনারকে বলেন, “প্রোপাগান্ডা সরকারের পক্ষে হোক বা বিপক্ষে হোক—সেটাকে আমরা খারাপ কাজ মনে করি। আমরা জানি না, কেন ভুয়া লেখকরা বাংলাদেশের নীতি নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন। এ ধরনের প্রচারণার সঙ্গে আমাদের সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।”

গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো ‘ভালো লেখক’ নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনো না।”

স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গত সেপ্টেম্বরে ভালো কলামিস্টের খোঁজ জানাতে কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন। কারণ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে লিখতে মন্ত্রণালয় কয়েকজন কলামিস্ট নিয়োগ করতে চেয়েছিল।

এ রকম বেশ কিছু নিবন্ধ ছেপেছেন এমন একজন সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বেনার। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, “আমরা বড়ো ভুল করেছি। বাড়তি জটিলতা এড়ানোর জন্য আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের শিল্প ইতিহাস বিভাগের অতিথি অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বেনারকে বলেন “এখন মানুষ তাদের মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে এমন তথ্য ও বিশ্লেষণ শুনতে চায়। এতে তথ্যবিভ্রাট বাড়ে। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নয়, পেশাদার মিডিয়াও সেই ফাঁদে পড়ে এবং মাঝে মাঝে ভুয়া খবর প্রকাশ করে।”

“বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারের প্রচারের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নিবন্ধ প্রকাশ করেছে এবং ভুয়া লেখকদের পরিচয় যাচাই করেনি,” বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বেনারকে বলেন, “এই ঘটনায় ঐতিহ্যগত সাংবাদিকতা মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন সরবরাহ করত এবং কিছু গণমাধ্যম হয়তো চাপের মুখে যাচাই না করেই সেগুলো প্রকাশ করত। এখন আমরা দেখছি তারা যাচাই না করেই নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এটা আশ্চর্যজনক।”

লিখলে ‘টাকা পাবেন’ প্রকাশ হবে ‘অন্যের নামে’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার একটি দৈনিকের সাংবাদিক বেনারকে বলেন, কয়েক মাস আগে তিনি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম প্রচারের জন্য লেখার প্রস্তাব পেয়েছিলেন।

“একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য আমাকে কয়েক মাস আগে কোভিড-১৯ ইস্যুতে সরকারি উদ্যোগের ওপর একটি নিবন্ধ লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জবাবে তাঁকে বলেছিলাম, আমি একটি মিডিয়া হাউসে কাজ করি, তাই অন্যের জন্য নিবন্ধ লিখতে আমার সমস্যা আছে। তিনি আমাকে বললেন, ‘সমস্যা নেই, নিবন্ধটি অন্যের নামে প্রকাশিত হবে এবং আপনি একটি ভালো পরিমাণ অর্থ পাবেন।’ আমি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।”

মাহবুবুর রহমান নামে এক বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বেনারকে বলেন, “তারা (সরকার) যা-ই বলুক না কেন, এর পেছনে সরকারের হাত থাকতে পারে, কারণ তারা এর সুবিধাভোগী। পাঠক হিসেবে আমরা প্রতারিত হয়েছি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।