মেটার সঙ্গে বৈঠক: নির্বাচনকালে ফেসবুকের ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তায় নির্বাচন কমিশন
2023.08.03
ঢাকা
আপডেট: ৪ আগস্ট ২০২৩। ইস্টার্ন সময় সকাল ১১:৩০
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফেসবুকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা উসকে দেওয়া কন্টেন্ট ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির মূল কোম্পানি মেটার শরণাপন্ন হয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হতে পারে, যা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছে ইসি।
বৃহস্পতিবার মেটার তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের সাথে এ বিষয়ে বৈঠক করে। ইসির সঙ্গে ফেসবুকের এ ধরনের বৈঠক এই প্রথম।
মেটার বাংলাদেশ বিষয়ক নীতির প্রধান রুজান সারওয়ার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তবে প্রতিনিধিদের কেউ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেননি।
বৈঠক শেষে অশোক কুমার বলেন, “আমাদের যে টেকনিক্যাল লোকজন আছে তাদের নিয়ে ফেসবুকের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বসেছিলাম। কারণ এখানে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে।”
তিনি বলেন, “মূলত লক্ষ্য ফেসবুকে যেসব অপপ্রচার হয়, সেগুলো কীভাবে রোধ করা যায়। বিশেষ করে ঘৃণাসূচক মন্তব্য, সাম্প্রদায়িকতা বা অন্যান্য যেসব ভায়োলেশন হয়। সেগুলো তারা (মেটা) ডিলিট করবে, রিমুভ করে দেবে বা ব্লক করবে। মূলত এই ছিল বৈঠকের বিষয়।”
তফসিল ঘোষণার পর থেকে ইসির সহায়তায় মেটা তাদের কার্যক্রম শুরু করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে যেটা নেগেটিভ প্রতীয়মান হবে, আমরা তাদের জানাব; তারা সেটাকে রিমুভ করে দেবে। শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন কনটেন্ট বিষয়ে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ফেসবুক কর্তৃপক্ষের আগ্রহে এ সভা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেনারের পক্ষ থেকে পাঠানো ইমেইলের উত্তরে শুক্রবার মেটার মুখপাত্র জানান তাঁদের প্লাটফর্মগুলোতে নির্বাচনকালীন তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে তাঁরা স্থিতিশীল নীতিমালা মেনে চলেন।
পাশাপাশি, ভুল তথ্য, ক্ষতিকর কনটেন্ট এবং ঘৃণা প্রচার রোধে সরকার, এনজিও ও সুশীল সমাজের সাথে “নিয়মিত সংলাপ ও যোগাযোগ” রক্ষা করা হয় বলে জানান ওই মুখপাত্র।
নির্বাচন বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন অংশীজনদের “ডিজিটাল অ্যাডভোকেসি, কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড, অনলাইন নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রচার” বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে জানান, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে সামাজিক মিডিয়ার অপপ্রচারে নামবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপতথ্য, গুজব রটানো বন্ধ করার সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তাই তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে,” বলেন অধ্যাপক নিজাম।
ইসি চাইলেই সরিয়ে ফেলবে মেটা?
সাইবার নিরাপত্তা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র এমনকি ভারত চাইলে গুজব, ভুয়া খবর, বিদ্বেষ, সহিংসতামূলক পোস্ট এবং কনটেন্ট ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে মেটা। এর কারণ হলো মেটা কর্তৃপক্ষ দেশগুলোকে সেই কর্তৃত্ব দিয়েছে।
তিনি বলেন, “তবে বাংলাদেশকে সেই সুবিধা দেয়া হয়নি। এর অন্যতম কারণ হলো, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো অবকাঠামোই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ডিডিপিআর (জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন) এর নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয় না।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জোহা বলেন, “জিডিপিআর মানলে জনসাধারণের তথ্যের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে সরকার। সেক্ষেত্রে সরকার কোনোভাবে জনগণের তথ্যের সুরক্ষা ব্যাহত করতে পারে না।”
তিনি বলেন, “জিডিপিআর ছাড়া যদি কোনো সরকারকে কনটেন্ট এডিট করার ড্যাসবোর্ডে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে সরকারি কর্তৃপক্ষ মেসেঞ্জারে মানুষ কী কথা বলছে সেগুলোতে হস্তক্ষেপ করবে। অর্থাৎ যেসব কর্তৃপক্ষ জনগণের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারবে না বলে মেটা মনে করে, তারা তাদের এই সুবিধা দেয় না।”
বর্তমান ব্যবস্থায় কোনো পোস্ট ফেসবুক থেকে সরাতে হলে মেটাকে জানাতে হয়, এরপর মেটা কর্তৃপক্ষ তাদের নীতি অনুযায়ী তা সরায় জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে সরকার অথবা নির্বাচন কমিশন তাদের যা বলবে সেটিই যে তারা করবে-এমন নিশ্চয়তা নেই।”
কেন মানুষ ভুয়া সংবাদ বিশ্বাস করে?
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আফরোজা সোমা বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বের সকল প্রান্তেই প্রথাগত মূলধারার গণমাধ্যমের চেয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন ধরনের ভুয়া সংবাদ, অপপ্রচার, সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে পারে এমন প্রচুর কনটেন্ট পাওয়া যায়, যা সাধারণ মানুষকে অনেকসময় প্রভাবিত করে জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগে এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।”
মানুষ কেন ভুয়া সংবাদ বিশ্বাস করে অথবা প্রভাবিত হয় এমন প্রশ্নের জবাবে আফরোজা সোমা বলেন, “মানুষের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ কাজ করে যে, প্রথাগত গণমাধ্যমগুলো প্রকৃত ঘটনা অনেক সময় চেপে যায় অথবা অনেকটা ফিল্টার করে জনগণের সামনে পরিবেশন করে।”
এই ফিল্টার করার কারণ দুটি বলে জানান তিনি। যার মধ্যে রয়েছে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ এবং গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্বমূলক আত্মনিয়ন্ত্রণ বা ‘সেলফ সেন্সরশিপ।’
“অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কোনো একটি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর আলোচিত হওয়ার পর মূলধারা গণমাধ্যমে সেটি প্রকাশিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হওয়ার কারণে মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এবং তারা সংবাদগুলো প্রচার করতে অনেকটা বাধ্য হচ্ছে,” বলেন আফরোজা সোমা।
তিনি বলেন, “তথ্য প্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ ও প্রথাগত মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর অনাস্থার কারণে মানুষ গুজব, ভুয়া সংবাদ অথবা অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়। সুতরাং এগুলো ঠেকাতে প্রয়োজন তথ্যের অবাধ প্রবাহ।”
বাংলাদেশে অপপ্রচারের কিছু দৃষ্টান্ত
অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ‘ডিসমিসল্যাব’ গত ৩০ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে পুরানো খবরের স্ক্রিনশট অথবা পুরানো ছবি ও ভিডিওকে এখনকার বলে প্রচার করা হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে তারা বলেছে, ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত গত ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচির ছবি হিসেবে তাদের ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের এক ঝলক’ দাবি করে টুইটারে চারটি ছবি পোস্ট করেন। কিন্তু যাচাই করে দেখা যায়, তাঁর টুইট করা চারটি ছবির অন্তত তিনটিই পুরোনো।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ২৯ জুলাইয়ের ছবি দাবি করে তাঁর ভেরিফায়েড টুইটার থেকে শেয়ার করেছেন পুরোনো একটি ছবি। সেখানে আগুনে পুড়তে দেখা যাচ্ছে ভিক্টর ক্লাসিক গণপরিবহনের একটি বাস। ছবিটি ২০২০ সালে রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকায় অগ্নিসংযোগের পুরোনো ছবি।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকের আরেকটি পোস্টে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের রক্তাক্ত ছবি শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে যে, সেটি সাম্প্রতিক সময়ের। কিন্তু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এই রক্তাক্ত ছবিটি ২০১৮ সালের।
বুমবিডিডটকম-নামের আরেকটি ফ্যাক্টচেকিং সাইটে ৩ আগস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কানাডার আদালতের একটি রায়ের বরাতে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়ার তথ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ও ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে যা বিভ্রান্তিকর।
প্রথম বাংলা ফ্যাক্টচেকিং সাইট বিডি ফ্যাক্টচেকের ২২ জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলিব্রেটিদের মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
গত ১৮ জুলাইয়ের আরেক প্রতিবেদনে তারা জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হিরো আলমের উপর হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার ইমরান খানকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য বলে প্রচার চালানো হয়, যা সঠিক নয়।
উল্লেখ্য, ফেসবুক বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ২০২১ সালে মেটার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়, সবার ওপরে ভারত এবং দ্বিতীয় ফিলিপাইন।
....................................................
আপডেট: প্রতিবেদনে মেটার বক্তব্য যোগ করা হয়েছে।