আবাসিক ভবনের নিচে রাসায়নিকের গুদাম, আগুন লেগে নিহত চার
2021.04.23
ঢাকা
নিচতলায় অবৈধ রাসায়নিক গুদাম থেকেই পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় ছয়তলা আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।
শুক্রবার ভোরে হাজী মুসা ম্যানশন নামের ওই ভবনটিতে আগুন লেগে চারজন নিহত ও আহত হয়ে অন্তত ২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
ভবনটি আবাসিক হলেও এর নিচতলায় ছিল রাসায়নিকের গুদাম। দোতলা থেকে ওপর পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বসবাস করত ১৮টি পরিবার। সেহরির সময় আগুন লাগায় বাসিন্দারা সবাই জেগে ছিলেন।
“ভবনটি আবাসিক হলেও এর নিচতলায় অপরিকল্পিত রাসায়নিকের মার্কেট ও গুদাম বানানো হয়েছিল। এগুলো ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদিত নয়,” বেনারকে বলেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (ঢাকা মেট্রো) দেবাশীষ বর্ধন।
গুদামের রাসায়নিকের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পাউডার ও লিকুইড জাতীয় কেমিক্যাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। রাসায়নিকের কারণে আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে।”
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে অবৈধ রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় ভয়াবহ আগুনে অন্তত ৭১ জন মারা যান।
সরকার বারবার চেষ্টা করেও পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনগুলো থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে পারেনি। ওই এলাকার কিছুসংখ্যক বাড়ির নিচে রাসায়নিক রাখতে গুদাম ভাড়া দেওয়া হয়।
মুসা ম্যানশনে আগুনের ঘটনাটি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
“আমি অবাক হই, সিটি করপোরেশন থেকে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক অনুমতি ছাড়াই কীভাবে তারা রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে, কীভাবে গুদামজাত করে এবং কীভাবে ব্যবসা করে,” সাংবাদিকদের বলেন মেয়র তাপস।
“কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ পর্যন্ত দায়িত্ব নিয়ে কাজ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমস্যা রয়ে যাবে,” বলেন মেয়র।
তবে পুরানো ঢাকায় বিস্ফোরক পরিদপ্তর অনুমোদিত রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কোনো গুদাম বা মজুদ নেই বলে বেনারকে জানান সরকারের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ।
“তবুও প্রতিবারই অগ্নিকাণ্ড হলে আমাদের যেতে হয়। জবাবদিহি করতে হয়,” বলেন তিনি।
পুলিশের তথ্যমতে, শুক্রবারের ওই আগুনে নিহতরা হলেন; ভবনের চারতলার বাসিন্দা ও রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার (২২), ওই ভবনের মার্কেটের প্রহরী রাসেল (২৮), রাসেলের ফুপা আরেক প্রহরী ওয়ালিউল্লাহ বেপারী (৭০) এবং রাসেলের কাছে বেড়াতে আসা কবীর নামে একজন।
‘আহতরা আশঙ্কামুক্ত নন’
“ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় ভোর ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সকাল নয়টার দিকে আগুন পুরোপুরি নেভানো গেছে,” বেনারকে বলেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন।
তিনি জানান, “ভবনে আটকে থাকা মানুষদের বারান্দা ও জানালার গ্রিল কেটে বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আহত ও মুমূর্ষু অবস্থায় ছিলেন।”
এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তিন কর্মী আহত হয়েছেন, এ ছাড়া উদ্ধার কর্মীদের কয়েকজন ধোঁয়ার কারণে অসুস্থও হয়ে পড়েন বলে জানান তিনি।
আহতদের তাৎক্ষণিকভাবে মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়।
“এ পর্যন্ত আমাদের কাছে ২১ জন এসেছে। চারজনকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউতে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা আশঙ্কামুক্ত নন,” বেনারকে বলেন হাসপাতালটির আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল।
এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের নিশ্চিত কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সিভিল ডিফেন্স।
ভবনের মালিক ও রাসায়নিক গুদামের মালিকের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিদ ফকির।
স্থানীয়রা বলেছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়ে বিদ্যুৎ চলে যায়। তাঁদের ধারণা বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।
হাজী মুসা ম্যানশনের পাশেই নির্মাণাধীন ভবনের নিচ তলায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এটিএম বুথে ঘুমাচ্ছিলেন নিরাপত্তাকর্মী বজলুর রহমান। বেনারকে তিনি বলেন, “সেহরির কিছু আগে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়। আগুনের ঝলকানি দেখে উঠে দাঁড়াই। বেরিয়ে দেখি পাশের ভবন হাজী মুসা ম্যানশনে আগুন জ্বলছে।”
“দৌড়ে গিয়ে দেখি তালা দিয়ে লোহার ফটক লাগানো। ভবনটির দারোয়ান ভেতরেই ছিলেন। চাবি খুঁজতে গিয়ে তিনি আটকা পড়েন,” বলেন তিনি।
বজলুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী এসময় কেউ একজন একটি জিআই পাইপ দিয়ে তালা ভাঙার পর ভেতর থেকে ৪৫/৫০ বছর বয়সের একজনকে উদ্ধার করা হয়। এরপর ধোঁয়ার কারণে আর কেউ ভেতরে যেতে পারেনি।
পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে ক্রেন ও মই দিয়ে ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে আটকে পড়া মানুষদের নামিয়ে আনেন।
একাধিক উদ্ধার কর্মীর বর্ণনা অনুযায়ী, রাসায়নিক থেকে নির্গত কালো ধোয়ায় ভবনটি ঢেকে যায়। ধোঁয়ার কারণেই বেশিরভাগ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে পাশের দুটি ভবন মক্কা টাওয়ার ও আমান কোর্ট থেকেও বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
‘আগুন লাগলেই জবাবদিহি’
প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, পুরানো ঢাকায় বিস্ফোরক পরিদপ্তর অনুমোদিত রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কোনো গুদাম বা মজুদ নেই। অথচ প্রতিবার আগুন লাগলে কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে যেতে হয় এবং জবাবদিহি করতে হয়।
“আজ সারাদিন আমাদের তিনজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে ছিল। সেখানকার দাহ্য পদার্থগুলোর বন্দোবস্ত করেই তারা ফিরেছে। অথচ দেশে আমদানি হওয়া দাহ্য রাসায়নিকের মাত্র পাঁচ শতাংশ আমরা অনুমোদন দিয়ে থাকি,” বলেন তিনি।
প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একেকটি রাসায়নিক আনার অনুমোদন একেকটি দপ্তর বা মন্ত্রণালয় দেয়। সবগুলোর খবর তাদের জানাও থাকে না।
সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ মোট ১০-১২টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারের ৯৫ শতাংশ দাহ্য রাসায়নিক আনার ছাড়পত্র দেয় বলে জানান তিনি।
“পুরানো ঢাকার অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে হলে সব ধরনের দাহ্য রাসায়নিক আমদানির অনুমোদনের বিষয়টি একটি দপ্তরের আওতায় নিয়ে আসতে হবে,” বলেন আবুল কালাম আজাদ।
২০১৯ সালের চুড়িহাট্টার ঘটনার পর সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ চালুর জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটা কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে, দুটি বৈঠকও করেছে কমিটি।”
ইতিমধ্যে এ বিষয়ক একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক বলেন, ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’টি তৈরি হলে “কে, কী আমদানির অনুমোদন দিচ্ছে বা কোথায় কতটুকু মজুদ রাখা হচ্ছে, তার একটা হিসাব অন্তত এক জায়গায় থাকবে।”
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় সব ধরনের দাহ্য রাসায়নিক আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন ও মজুদের ছাড়পত্র দেবার বিষয়টি একটি দপ্তরের আওতায় নিয়ে আসা সম্পর্কে “আলোচনা” চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এর জন্য নতুন আইন ও বিধিমালা প্রস্তুত করতে হবে।”
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।