সিলেটে বন্যা: ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি
2022.06.17
ঢাকা

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মেঘালয় রাজ্যে গত কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মারাত্মক বন্যা দেখা দিয়েছে।
পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট এই বন্যায় সরকারি হিসাবে সিলেট ও সুনামগঞ্জের কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন, প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে হবিগঞ্জ জেলার আজমীরিগঞ্জসহ আশেপাশের এলাকা।
বন্যা কবলিত জেলাগুলোর আট উপজেলায় তীব্র খাদ্য, পানি ও বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকলেও প্রতিক্ষণই আসছেন নতুন আশ্রয়প্রার্থী।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন নারী ও শিশুরা। এলাকার সকল টয়লেটে পানি ঢোকায় তাঁরা টয়লেট ব্যবহার করতে পারছেন না।
এদিকে আগামী দুই থেকে তিন দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে জানিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া শুক্রবার বেনারকে বলেন, এর ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
বন্যা আক্রান্ত এলাকার পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করতে ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।
এদিকে সিলেট অঞ্চলে বন্যার কারণে ১৯ জুন শুরু হতে যাওয়া এস.এস.সি এবং সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

২০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে
সিলেট সদর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, দিরাই, দোয়ারাবাজার এবং ছাতক উপজেলা বন্যার কবলে পড়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।
ওইসব এলাকার কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, পানিবন্দি মানুষদের বাড়িঘর থেকে উদ্ধার করে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পূর্বাভাস অনুযায়ী হবিগঞ্জ জেলার আজমীরিগঞ্জসহ আশেপাশের এলাকায় বন্যা দেখা দেবার আশঙ্কা রয়েছে।
জেলাগুলোর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও সরকারি স্থাপনায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে, জানান ড. মোশাররফ হোসেন।
‘কোনো শুকনা জায়গা নেই‘
বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকার একটি সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা।
কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বাসিন্দা মো. আজমত আলী শুক্রবার বেনারকে বলেন, “কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় এখন আর কোনো শুকনা স্থান নেই। সবখানেই পানি আর পানি।”
তিনি বলেন, “সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বৃহস্পতিবার থেকে পানিতে ডুবে গেছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার একতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। দুই তলায় বন্যার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।”
আজমত আলী বলেন, পর্যাপ্ত নৌকা না থাকায় বানভাসি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের এখানকার বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।
পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা
কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা আসনের কাউন্সিলর রাজিয়া বেগম শুক্রবার বেনারকে বলেন, “আমার ইউনিয়নে শুধুমাত্র আমাদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে পানি ঢোকেনি। সবাই ওই বাড়িতে ভিড় করছে। মহিলা ও শিশুরা ভেজা কাপড়ে দিন কাটাচ্ছে। আর বন্যার পানি হিম শীতল। পানি এতো ঠাণ্ডা যে আপনি পাঁচ মিনিট পানিতে থাকতে পারবেন না।”
তিনি বলেন, “মহিলারা দুই-তিন ধরে কোনো খাবার ও পানি খেতে পারেনি। চারদিন ধরে এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুতের অভাবে মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো খবর আমরা পাচ্ছি না। আমরা এক ভয়াবহ অবস্থায় মধ্যে আছি।”
পানির তোড়ে উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের নাজিরগাঁও গ্রামের নীলজান বেগম (৬২) এর বসতবাড়ি ভেসে গেছে।
তিনি শুক্রবার মোবাইল ফোনে বেনারের সাথে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।
নীলজান বেগম বলেন, “আমার সারাজীবনের সম্পদ চারটি গরু, পাঁচ ছাগল, ২০টি হাঁসমুরগি পানিতে ভেসে গেছে। আমার সব শেষ।”
সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলা বাহাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ভানু চাঁদ দাস শুক্রবার বেনারকে বলেন, শাল্লা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের সবগুলো বন্যায় আক্রান্ত। শাল্লার প্রধান সড়কের কিছু অংশ পানিতে এবং কিছু অংশ শুকনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
ভানু চাঁদ বলেন, “আজকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষদের সাহায্য করা হয়। কিন্তু সারাদিন কোনো মানুষ ঘরবাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। কারণ ঝড়-বৃষ্টি চলছেই। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে আগামীকালের মধ্যে পুরো শাল্লা পানিতে ডুবে যাবে।”
বিভিন্ন স্কুল, কলেজে বন্যার্ত মানুষদের সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে জানিয়ে ভানু চাঁদ বলেন, “গত তিন দিন ধরে শাল্লায় বিদ্যুৎ নেই। কারণ ছাতকে বিদ্যুৎ স্টেশনে পানি ঢুকেছে।”

বিশুদ্ধ পানির অভাব
সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায়ও বন্যার পানি ঢুকেছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. আ.ক.ম. মাহবুবুজ্জামান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “সিলেটে আমার ২৮ বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। আমাদের আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।”
“এখানে পানিবন্দি হয়ে পড়েছি। বিদ্যুৎ নেই। বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে মোবাইল ফোনও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জানি না অবস্থা কী দাঁড়াবে,” বলেন মাহবুবুজ্জামান।
বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিতরণকেন্দ্রে পানি ঢুকে পড়েছে বলে শুক্রবার বেনারকে জানান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ শাখার পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হবে।
‘পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে’
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় এলাকা চেরাপুঞ্জিতে। বৃহত্তর সিলেট চেরাপুঞ্জির কাছেই অবস্থিত। সে কারণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সিলেট অঞ্চলে।
সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে বড়ো বড়ো হাওর যেগুলো ভারত থেকে আসা সীমান্ত নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত।
সম্প্রতি ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি বিভিন্ন নদী দিয়ে ভাটিতে অবস্থিত সিলেটাঞ্চলে প্রবেশ করেছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দেয়া বন্যা পরিস্থিতির মানচিত্র অনুযায়ী সুরমা নদীর পানি সিলেট সদর, কানাইঘাট, সুনামগঞ্জ, দিরাই পয়েন্টে বিপদসীমার এক মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ জেলার লরেরগড় পয়েন্টে জাদুকাটা নদী এবং নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়াজাঞ্জাইল পয়েন্টে বিপদসীমার এক মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এছাড়াও, উত্তরপশ্চিমের জেলা কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ধরলা নদী এবং রংপুর জেলার ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার এক মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসের পর এটি বৃহত্তর সিলেট জেলায় তৃতীয় দফা বন্যা বলে বেনারকে জানান বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রধান আরিফুজ্জামান।
তিনি বলেন, “আগামী তিন থেকে চার দিন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বলা যায় আগামী কয়েকদিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।”