বন্যা: সিলেট-সুনামগঞ্জে পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবনতি
2022.06.21
ঢাকা

বৃহত্তর সিলেটে গত কয়েকদিন ধরে চলা বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
উজানে ভারতের মেঘালয় আসাম রাজ্যে বন্যার কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ১১ জেলার বিভিন্ন উপজেলা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ১৭ মে থেকে ২১ জুন পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন্যার কারণে মোট ৩৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু সিলেট বিভাগেই মারা গেছেন ১৮ জন।
খাদ্য সরবরাহে টান পড়তে পারে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে দেশের খাদ্যমূল্য বেড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সিলেট ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যার কারণে দেশের খাদ্য সরবরাহে টান পড়তে পারে।
এছাড়া বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে পানি ও খাদ্যবাহিত বিভিন্ন রোগ বালাই দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বন্যা আক্রান্ত অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি পৌঁছাতে সরকার সমস্যায় পড়ছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন।
সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বর্তমানে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১১ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।
তিনি বলেন, “বন্যা মোকাবিলার জন্য আমরা বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী নিশ্চিত করার পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি।”
“প্রধানমন্ত্রী নিজে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি দেখেছেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি মানুষের তালিকা প্রস্তুত করে তাঁদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে। সরকার জনগণের সাথে রয়েছে,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।
বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ জেলার কমপক্ষে ৪৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানিয়েছেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ড. মোশাররফ হোসেন।
ইতোমধ্যে পানি নামতে শুরু করেছে। মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরবাড়িতে ফিরে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে, বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মোবাইল সংযোগ নেই। অনেক মানুষ যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারেননি তাঁদের ব্যাপারে খবর পাচ্ছি না।”
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় শুকনা খাবার, পানি শোধন বড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা এখন আমাদের জন্য বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
বিপদসীমার ওপরে নদীর পানি
বন্যার পানি পুরোপুরি নেমে না যাওয়ায় অনেকে অনাহারে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছেন। সবচেয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন বুকের দুধ খাওয়া শিশু ও মায়েরা।
সুনামগঞ্জের দক্ষিণ বর্গাপন গ্রামের বাসিন্দা স্বপ্না আখতার সাদিয়া পাঁচদিন ধরে কয়েক মাস বয়সের শিশু নিয়ে জেলার ডেবরাবাজার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।
মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের ঘরের মধ্যে তিন ফুট পানি। আমরা জায়গা না পেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। আমাদের খাবার কিছু নেই। বাচ্চাটি বুকের দুধ পাচ্ছে না।”
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে বর্তমানে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা,, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও সিলেটের বিভিন্ন পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমার এক মিটার বা আরো ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম শাওন (২৩) মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমাদের এখানে গত দুদিন ধরে নদীতে পানি বেড়েছে। আমাদের প্রধান সড়ক প্রায় ডুবে যাওয়ার অবস্থায় পর্যায়ে আছে। অবস্থা ভালো নয়। আমরা ভয়ে আছি কখন কী হয়!”
একই উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল হামিদ শেখ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমাদের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের অবস্থা ভয়াবহ। ইতোমধ্যে ছয় নম্বর, সাত নম্বর আট নম্বর, নয় নম্বর ওয়ার্ড ডুবে গেছে। চার নম্বর ওয়ার্ডও ডোবার পথে।”
তিনি বলেন, “ব্রহ্মপুত্র নদী ভাঙা শুরু হয়েছে। মানুষ সরে যাচ্ছে। জানি না কী হবে।”
“সিলেটাঞ্চলে বন্যার উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু আবার অবনতির প্রবণতা দেখা দিয়েছে,” বলে বেনারকে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আব্দুল লতিফ খান।
তিনি বলেন, “হঠাৎ পানি বৃদ্ধির কারণ হলো আজকে উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গতকালের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। সেকারণে আজ আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে।”
আসামের বন্যার পানির কিছু অংশ বৃহত্তর সিলেটের নদ-নদী হয়ে মেঘনার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে নেমে যাবে জানিয়ে জানিয়ে আব্দুল লতিফ বলেন, আর আর কিছু অংশ ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে কুড়িগ্রাম থেকে শুরু গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জসহ অন্যান্য জেলাকে আক্রান্ত করতে পারে।
“ব্রহ্মপুত্রের পানি ইতোমধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, তবে এখনো পদ্মা (গঙ্গা) নদীতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি। কোনোভাবে যদি ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনার পানির প্রবাহ একসাথে পিক (সর্বোচ্চ) পর্যায়ে যায় তাহলে আমাদের অবস্থা খারাপ হবে।”
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যার প্রভাব দেশের খাদ্য সরবরাহে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, “বন্যা শুরুর আগেই হাওরাঞ্চলের মানুষ ধান কেটে ফেলেছিলেন। তবে তাঁরা তো ধানগুলো তাঁদের বাড়িঘরে রেখেছেন। বাড়িঘর ডুবে গেছে। ফলে তাদের খাদ্যশস্য অনেকাংশে নষ্ট হয়েছে। এর প্রভাব তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে এবং সার্বিকভাবে বাজারে পড়বে।”
খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বন্যা পরবর্তীতে ওইসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব ও পানিবাহিত রোগবালাই দেখা দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই অঞ্চলের মানুষদের নগদ অর্থ অথবা খাদ্য সহায়তা দিতে হবে।”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ওয়াইস কবিরের মতে, “বৃহত্তর সিলেটে বন্যার আগেই সেখানকার বোরো ধান কাটা হয়েছে। সুতরাং, সেখানে শস্য নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে সমস্যা হবে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যেখানে বন্যা শুরু হয়েছে।”
তিনি বলেন, “ওই অঞ্চলে মে-জুন-জুলাই মাসে আউশ ধান চাষ করেন চাষিরা। তা ছাড়া অন্যান্য ফসল চাষ হয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে আমন ধান চাষ শুরু হয়। আমাদের মোট উৎপাদিত ধানের মধ্যে প্রায় ৫৫ ভাগ বোরো। আউশ ধান শতকরা একভাগের মতো। সুতরাং, আপাতত খুব বেশি ধান নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই।”