বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকার অপরিকল্পিত সড়ক ও সেতু মেরামত করবে না সরকার

আহম্মদ ফয়েজ
2022.06.28
ঢাকা
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকার অপরিকল্পিত সড়ক ও সেতু মেরামত করবে না সরকার বন্যায় ডোবা ঘর থেকে পরিবার নিয়ে নৌকায় করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে সিলেটের একটি পরিবার। ১৯ জুন ২০২২।
[রয়টার্স]

হাওর এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে সড়ক ও সেতু নির্মাণ করায় মানুষের উপকারের বদলে ক্ষতি বেশি হয়েছে- চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা এমন মূল্যায়ন করে আসছিলেন। এই পরিস্থিতিতে চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও মৌলভীবাজারের সড়ক মেরামত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

বন্যা সামাল দিতে যেসব সড়ক ও সেতু ভেঙে ফেলা হয়েছে বা পানির তোড়ে ভেঙে গেছে সেগুলোকে মেরামত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে ফ্লাইওভার নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী এই অনুশাসন দেন বলে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

“সাম্প্রতিক বন্যায় পানি সরাতে এসব সড়ক কেটে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া বন্যায় অনেক সড়ক ও সেতু ভেঙে গেছে,” জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “পানি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে এসব ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় নতুন করে সড়ক নির্মাণ না করে সেতু, ফ্লাইওভার অথবা কালভার্ট নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।”

তিনি বলেন, হাওর বা বন্যা প্রবণ এলাকায় সড়ক নয়, ব্রিজ অথবা কালভার্ট নির্মাণ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যাতে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি না হয়।

এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শহরের রেল ক্রসিংয়ে ওভারপাস নির্মাণের পাশাপাশি আরো কোথাও ওভারপাস, আন্ডারপাস দরকার আছে কি না, তাও প্রধানমন্ত্রী খুঁজে বের করতে বলেছেন বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।

“নৌ রুটে কালভার্টের পরিবর্তে ব্রিজ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা,” বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় কয়েক দশক ধরে সিলেট ও সুনামগঞ্জ মারাত্মক বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

এ ছাড়া প্রবল বৃষ্টি, সিলেট অঞ্চলের হাওর অধ্যুষিত মানবসৃষ্ট অবকাঠামোকে বন্যায় মৃত্যু ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

হাওরে সড়ক নির্মাণ ছিল অপরিকল্পিত

কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে নির্মিত ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের দীর্ঘ সড়কসহ ওই অঞ্চল ও সিলেটের বিভিন্ন হাওরে তৈরি সড়কগুলোকে অপরিকল্পিত ও আত্মঘাতী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাঁরা বলছেন, এসব সড়কের ফলে অসময়ে বন্যা দেখা যাচ্ছে এবং এতে করে প্রাণহানির পাশাপাশি তলিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল।

সাম্প্রতিক বন্যায় দেখা গেছে কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় প্রায় ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬-২০২০ সালের মধ্যে নির্মিত সড়কটির কারণে ঢলের পানি হাওর থেকে দ্রুত নদীতে নামতে পারছে না।

“আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি প্রাকৃতিক জলধারার গতিপথ বিনষ্ট করে কোনো সড়ক যেমন নির্মাণ করা না হয়। এমনটি হলে ইকো সিস্টেমের যেমন ক্ষতি, তেমনই রয়েছে ব্যাপক বন্যার সম্ভাবনাও। এবারও তাই দেখা গেল,” বেনারকে বলেন পানিসম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।

তিনি বলেন, “এখন সরকারই বলছে যে, এই সিদ্ধান্তগুলো ঠিক হয়নি। তাহলে কী হলো, অর্থের ক্ষতি তো হলোই, প্রাণহানি ঘটল।”

চলমান বন্যা দেশের ভেতরের বৃষ্টির জন্য হয়নি বরং উজানের চেরাপুঞ্জিতে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে উজানে বৃষ্টি আরও বাড়তে পারে।

“উজানে যদি ভবিষ্যতে বৃষ্টি বাড়ে তাহলে দেশের মধ্যে অল্প বৃষ্টি হলেও বন্যা হতে পারে। সুতরাং শুধু বৃষ্টি নয়, এই বন্যা ঠেকাতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হবে,” বলেন আইনুন নিশাত।

সরকারের “ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই হাওর ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, যা মারাত্মক বিপদের কারণ,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।

তাঁর মতে, সরকারকে অবশ্যই এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয় যাতে করে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে।

বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ৮৬, রোগে ভুগছেন ৭৭৩১

দেশে বন্যা ও বন্যায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এই তথ্য জানিয়েছে।

মৃতের মধ্যে সিলেট বিভাগের ৫৩ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে ২৮ জন এবং রংপুর বিভাগে এ পর্যন্ত পাঁচজন মারা গেছেন।

গত ১৭ মে থেকে মঙ্গলবার (২৮ জুন) পর্যন্ত সময়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্যায় জেলাভিত্তিক মৃত্যুর সংখ্যার শীর্ষে রয়েছে সুনামগঞ্জ। ১৭ মে থেকে ২৮ জুনের মধ্যে এ জেলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিলেট জেলায় মারা গেছেন ১৮ জন। এ ছাড়া হবিগঞ্জে চারজন ও মৌলভীবাজারে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

নেত্রকোণা ও জামালপুরে বন্যা ও বন্যায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯ জন করে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ময়মনসিংহে মারা গেছেন পাঁচজন। এ ছাড়া শেরপুরে পাঁচজন, কুড়িগ্রামে চারজন ও লালমনিরহাটে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

এ ছাড়া মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্যাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৭৩১ জন।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উজানে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে, যার ফলে দেশের অল্প কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। তবে বেশিরভাগ অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, তিস্তা ছাড়া দেশের সকল প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।