বন্যায় ২০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগ
2024.07.08
ঢাকা
বৃহত্তর সিলেটের পর বন্যা আক্রান্ত বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় সুপেয় পানি সংকটে উদরাময় ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।
বন্যার্তদের অভিযোগ, বৃহত্তর সিলেটে গত একমাসে তিন দফা বন্যায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও পানিবন্দি মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও সুপেয় পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। একই অভিযোগ কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর জেলার বানভাসি মানুষের।
সরকারি হিসাবে, দেশে চলমান বন্যায় কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যাঁদের একটি বড়ো অংশ প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়াই পানিবন্দি অবস্থায় দিনরাত পার করছেন।
তবে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ পানিবাহিত রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন, সেব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কাছে নেই।
গত একমাস ধরে সিলেটে বার বার বন্যায় পুরো এলাকার টিউবওয়েলগুলো পানিতে ডুবে যাবার ফলে সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল হক বেনারকে বলেন, “খাবারেরও পর্যাপ্ত সংস্থান নেই। অনেকেই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে পাতলা পায়খানায় ভুগছে বন্যার্ত শিশুরা।”
তিনি জানান, বন্যার কারণে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, যা পানিবাহিত রোগের বড়ো একটি কারণ।”
“খাবার স্যালাইন থাকলেও বিশুদ্ধ পানি সবসময় পাওয়া যায় না,” বলেন আব্দুল হক।
তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান সোমবার বেনারকে বলেন, সিলেটে তিন দফায় বন্যা হলেও পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত কমপক্ষে ছয় লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যাদের একটি বড়ো অংশ পানিবন্দি।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং সেখানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এছাড়া, পানিবন্দি মানুষদের কাছে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে।”
‘স্বাস্থ্যসেবা দেয়াও কঠিন’
এদিক নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় প্রায় পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে বলে বেনারকে জানান কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার বাসিন্দা আজিজুল হক।
তিনি বলেন, “আমাদের বাড়ির ভিতরে কোমর পানি। সুপেয় পানি এখন সবচেয়ে বড়ো সমস্যা।”
এর পাশাপাশি এলাকায় রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই বলে জানা তিনি।
“এলাকার অধিকাংশ গরিব মানুষ খেয়ে না খেয়ে আছেন। সরকারি সাহায্যও তেমন আসছে না,” বলেন আজিজুল হক।
কুড়িগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ মো. মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ সোমবার বেনারকে বলেন, নদীর পানি বেড়ে উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়ন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। গত সাতদিন ধরে এলাকায় বন্যা চলছে।
তিনি বলেন, “বন্যার পানিতে এখানকার অধিকাংশ টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় নিরাপদ পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ মানুষই উদরাময়, চর্মরোগসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বন্যার পানি নেমে গেলে এই সকল স্বাস্থ্য সমস্যা আরও বাড়বে।”
স্বাস্থ্যকর্মীরা নৌকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বন্যার্তদের পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, খাবার স্যালাইনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করে আসছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ঠিক কত সংখ্যক মানুষ বর্তমানে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন সেটি বর্তমানে বলা সম্ভব নয়। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।”
গত তিন-চার দিন ধরে বন্যার পানিতে প্রায় পুরো এলাকা ডুবে গেছে বলে বেনারকে জানান জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা মো. সোহেল। এলাকার বন্যার্তরা স্কুল, কলেজ ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
“কিছু কিছু মানুষ খিচুড়ি বিতরণ করলেও সরকারি ত্রাণ তেমন চোখে পড়েনি,” বলেন সোহেল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী জামালপুর জেলার পাঁচটি উপজেলা গত ছয়-সাত দিন ধরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা হলো দেওয়ানগঞ্জ ও ইসলামপুর। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা দুই লাখের ওপরে।
এদিকে জেলার ২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকে পানি ঢোকায় পানিবন্দি মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে সোমবার বেনারকে জানান জামালপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ ফজলুল হক।
তিনি বলেন, “নিরাপদ পানির অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। বন্যার সময় এবং বন্যার পরে উদরাময় এবং চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের অসুখ দেখা দেয়। তবে আমাদের হাতে পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি রয়েছে যেগুলো বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে।”
২০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
অতি বৃষ্টিপাত, সীমান্ত নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর সিলেট জেলায় এক মাসে তিন দফা বন্যার সাথে গত সপ্তাহ থেকে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলো।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে সোমবার পর্যন্ত ওই দুই অঞ্চলসহ দেশের ১৫ জেলায় ২০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, যাঁদের একটি বড়ো অংশ দিনের পর দিন পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলো হলো: কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা, ফেনী ও রাঙ্গামাটি।
তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, ও সিলেট।
এক মাস ধরে চলছে বন্যা
সীমান্তের ওপারে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয় ও আসামে অতিবৃষ্টির ফলে গত মাসের প্রথম দিকে ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের সিলেট জেলায় ফ্ল্যাশফ্লাড শুরু হয়। এর সপ্তাহ খানেক পর পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা দেখা দেয়।
ওই বন্যার প্রভাব গিয়ে পড়ে হাওর অঞ্চলের নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ জেলায়।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী সোমবার বলেন, গত ১৭ জুন থেকে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। সীমান্তের ওপারে মেঘালয়ে এবং বাংলাদেশে অতিবৃষ্টির কারণে এই বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ৩০ জুন থেকে পুনরায় পানি বৃদ্ধি হতে থাকে এবং জেলার সব উপজেলা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সোমবারের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লাখ।
জেলা প্রশাসক রাশেদ চৌধুরী বলেন, বন্যা পরিস্থিতি পুরোপুরি উন্নতি না হওয়ায় এখনও প্রায় সাড়ে তিনশ আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ বসবাস করছে। অনেক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
তিনি বলেন, বন্যার সময় চর্মরোগ, ঠাণ্ডা, জ্বর, কাশি, উদরাময়সহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।
রাশেদ ইকবাল বলেন, পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। বন্যার পানি নেমে গেলে স্বাস্থ্য সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
তিনি বলেন, পানিবাহিত রোগ ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে বন্যার্তদের মাঝে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া, পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও বন্যা
সিলেট অঞ্চলে বন্যা আঘাত করলেও তখন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়নি।
সীমান্ত নদী যমুনা, ধরলা ও দুধকুমারের পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার উত্তর-পশ্চিমের জেলা কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যা অব্যাহত রয়েছে। সোমবারও কুড়িগ্রামের কচাকাটায় এলজিইডি বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে পাঁচ গ্রাম।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান সোমবার বেনারকে বলেন আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলায় এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
তিনি বলেন, তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা ও গঙ্গানদীর পানি বৃদ্ধি পাবে।