টানা বৃষ্টি: ঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ লাখো পানিবন্দি মানুষ
2023.08.08
ঢাকা ও কক্সবাজার
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি, বন্যা ও ভূমিধসের কারণে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার ইতোমধ্যে উদ্ধার তৎপরতার জন্য সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছে।
হাসপাতাল, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সোমবার থেকে মঙ্গলবার বিকেল নাগাদ কক্সবাজারের উখিয়া ও চকরিয়ায় এবং বান্দরবানে পাহাড় ধসের আলাদা ঘটনায় চার রোহিঙ্গাসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে সোমবার চার রোহিঙ্গাসহ ছয়জনের এবং মঙ্গলবার আরো একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
বান্দরবান-রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান-চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন এলাকা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এবং প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার অনেক এলাকা বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে।
সেনা ও নৌবাহিনী মোতায়েন
ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানের জনসাধারণকে উদ্ধারসহ ত্রাণ তৎপরতার জন্য মঙ্গলবার সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে সরকার।
একইসাথে কক্সবাজার জেলায় নৌবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার সশস্ত্রবাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আইএসপিআর জানিয়েছে।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত চলছে। এই কয়েকদিনের মধ্যে সেখানে ৩৪০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক বজলুর রশীদ।
প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে ১৪টি কমবেশি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এছাড়াও, বান্দরবান জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার কিছু অংশ কয়েক ফুট পানির নিচে। জেলার সাথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পানি নেমে যাওয়ার পর তিন জেলায় ভূমিধসের ঘটনা আরও বাড়তে পারে।
ভূমিধসের আশঙ্কা
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিধস একটি বিরাট সমস্যা। প্রায় প্রতিবছর এই দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ প্রাণ হারান।
২০০৭ সালের ১১ জুন হাটহাজারী এলাকায় এক ভূমিধসে কমপক্ষে ১২২ ব্যক্তি প্রাণ হারান। নিহতরা পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করতেন এবং ওপর মাটি ধসে তাঁদের ওপর পড়ে।
দশবছর পর ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙ্গামাটিতে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জন, বান্দরবানে ছয় জন, কক্সবাজারের দুইজন ও খাগড়াছড়িতে একজনের প্রাণহানি ঘটে।
বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ-আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও গবেষক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন এবং গাছ কেটে নেয়ার কারণে ভূমিধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে।
মানুষ বাড়ার সাথে সাথে গত তিন দশকে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গাছ কাঁটার প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আমাদের পাহাড়গুলো মাটির। পাহাড়ের গায়ে গাছপালাগুলোর শেকড় মাটি ধরে রাখে। এছাড়া, বৃদ্ধির পানি প্রথমে গাছের পাতায় এবং ডালে পড়ে এবং চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিচের দিকে নেমে যায়।”
“গাছ কাটার ফলে মাটি আলগা থাকছে এবং বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূমিতে আঘাত করছে। ফলে মাটি নরম হয়ে একসময় ভেঙে যায়,” বলেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
“এর সাথে রয়েছে পাহাড় কাটা। পাহাড়ের মাটি কাটলে পাহাড়ের ভারসাম্য থাকে না। একসময় সেটি ভেঙে পড়ে,” যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার পর হইচই পড়ে যায় এবং কিছুদিন পর মানুষ সব ভুলে যায়। সমস্যার আর সমাধান হয় না।
আতঙ্কে রোহিঙ্গারা
টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে রোহিঙ্গারা পাহাড় ধসের আতঙ্কে রয়েছেন বলে বেনারকে জানান রোহিঙ্গা নেতা মো. জুবায়ের।
তিনি বলেন, উখিয়ার বালুখালীর ৯,১০ নম্বর মধুরছড়ার ৬,৭ নম্বর এবং চাকমারকুলের ২১ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরসহ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শিবির পাহাড়ে অবস্থিত। ফলে এসব শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গা খুব আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
মধুরছড়া রোহিঙ্গা শিবিরের রহিমা খাতুন বলেন, “মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর এই ক্যাম্পের পাহাড়ের নিচে ঘর করে চার সন্তান নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলাম। প্রায় সময় এখানে পাহাড় ধস ও ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে। তাই ভারী বৃষ্টি হলেই খুব আতঙ্কে থাকি।”
কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, গত রোববার থেকে মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ৩৬৪ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
আরও সপ্তাহখানেক বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারী বর্ষণের কারণে ভূমি বা পাহাড় ধসের আশঙ্কাও রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান জানান, জেলার ৯ উপজেলার ৭১ ইউনিয়নের ৬০টি বন্যায় প্লাবিত হয়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন।
তিনি জানান, বন্যায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে চকরিয়া ও পেকুয়ার মানুষ। এর মধ্যে চকরিয়ায় দুই লাখ ১০ হাজার এবং পেকুয়া ৮৫ হাজার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
সোমবার জেলার উখিয়ায় উখিয়ায় বালুখালীর ৯ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের একটি বসত ঘরে মাটি চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই জান্নাত আরা (২৮) ও তার দুই বছরের মেয়ে মাহিমা আক্তারের মৃত্যুর পর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী শতাধিক রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, উখিয়ার বালুখালী, মধুরছড়া, চাকমারকুলসহ যে সব রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পাহাড় ধস ও বন্যার ঝুঁকি রয়েছে সেসব ক্যাম্প থেকে ইতিমধ্যে শতাধিক পরিবারকে আশেপাশের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালের ২৭ জুলাই উখিয়ার ১০ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে পাহাড় ধস ও পানিতে ডুবে ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
যে কারণে পাহাড় ধস
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক বজলুর রশীদ বেনারকে বলেন, “বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এমন বৃষ্টিপাত অস্বাভাবিক নয়। চট্টগ্রামে ৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে। দুই-এক বছর পর পর বর্ষাকালে সেখানে এমন বৃষ্টিপাত হয়।”
তিনি জানান, এই বৃষ্টিপাতের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় ভূমিধস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে ভূমিধসের পূর্বাভাস জারি করা হয়েছে।
ভূমিধসের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “পাহাড় এবং গাছ কাটা ভূমিধসের অন্যতম কারণ। এছাড়াও, পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সঠিকভাবে পাহাড় কাটা না হওয়ায় বৃষ্টির পানি পড়ে মাটি নরম হয়ে ভূমিধস হয়।”
বজলুর রশীদ বলেন, পাহাড়ের নিচ দিকে বেশি মাটি কেটে ফেললে ভূমিধস হয়।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা মোশারফ হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলেও দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে পানি নেমে যায়।
তিনি বলেন, “আমি ১৯৭৬ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামে আসি। সেই বছরই একটানা ছয় দিন বৃষ্টি হয় এবং প্রায় পুরো চট্টগ্রাম ডুবে। এত বছর পর আবার এমন বৃষ্টি দেখলাম।”
মোশারফ হোসেন বলেন, “বহদ্দারহাট, কালুরঘাট, খাতুনগঞ্জ, জিইসি মোড়সহ আশেপাশের এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। আমার ছোট ভাইয়ের বাড়ির একতলা পানির নিচে চলে গেছে। এবার পানি নামছে না।”
তিনি বলেন, খাতুনগঞ্জ বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র এই এলাকা নিমজ্জিত হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট দেখা দেবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম. জহিরুল আলম দোভাষ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এবছর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। গত ৩০ বছর এমন বৃষ্টি হয়নি। সেকারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি বলেন, “চট্টগ্রামে বৃষ্টি পানি দুটো খাল দিয়ে কর্ণফুলী হয়ে সাগরে চলে যায়। আমরা খালগুলোর আশেপাশের অবৈধ স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদ করে পরিষ্কার করেছি যাতে পানি প্রবাহ ঠিক থাকে।”
জহিরুল আলম বলেন, “তবে সমস্যা হলো, শহরের বিভিন্ন ছোটখাট নর্দমাগুলো পরিষ্কার করেনি সিটি কর্পোরেশন। সেগুলো আবর্জনায় বন্ধ হয়েছে। পানি নর্দমা হয়ে খালগুলোতে পড়তে পারছে না। ফলে শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।”
তিনি বলেন, শহরের নর্দমাগুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তারা সেই কাজ করেনি।”
তবে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার জন্য কেবলমাত্র সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন ছাড়াও এখানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, টিঅ্যান্ডটি, গ্যাস কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর রয়েছে। কিন্তু সকল সমস্যার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা হয় যা সঠিক নয়।