ফ্রান্স থেকে বিমান কিনবে বাংলাদেশ
2023.09.11
ঢাকা
ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের যৌথ মালিকানাধীন এয়ারবাস কোম্পানি থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০টি উড়োজাহাজ কিনতে রাজি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ঢাকায় সফররত ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।
একইসঙ্গে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশসহ সমমনা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে বহিঃশক্তির প্রভাব থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে সবার জন্য উন্মুক্ত, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ রাখতেও অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
দু’দিন সফরের শেষ দিনে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে সাক্ষাত শেষে সেখানে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অঙ্গীকারের কথা জানান।
মাখোঁ ফরাসি ভাষায় বক্তব্য রাখেন। দোভাষী না থাকায় গণমাধ্যমকর্মীরা তাঁকে কোনো প্রশ্ন করতে পারেননি। বিকেলে তিনি ঢাকা ত্যাগ করার পর এই সফর সংক্রান্ত যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।
সেখানে বলা হয় যে, ১০টি এয়ারবাস কিনতে রাজি হওয়ায় ফরাসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ফ্রান্স মনে করে ইউক্রেন যুদ্ধ জাতিসংঘ সনদসহ সব আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
চলতি বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের ওপর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতেও একই ধরনের কথা ছিল। মাখোঁর সফরে এই ধরনের রাশিয়াবিরোধী বিবৃতি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ দু’দিন আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।
রোববার ভারত থেকে বাংলাদেশ সফরে আসেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ফ্রাঁসোয়া মিতেরার পর মাখোঁই হলেন প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট যিনি বাংলাদেশে এলেন।
১০টি এয়ারবাস উড়োজাহাজ
জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে বর্তমানে মোট ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে পাঁচটি ছাড়া সবগুলোই বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো উড়োজাহাজ নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানি থেকে কেনা।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজম সোমবার বেনারকে বলেন, “এয়ারবাস কোম্পানির পক্ষ থেকে এ বছরের মে মাসে জানানো হয়, তারা বিমানকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০টি উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে পারবে। বিমান কর্তৃপক্ষও আগ্রহ দেখায়।”
তিনি বলেন, “এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই মাসে এয়ারবাস জানায়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দু’টি উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে পারবে।”
শফিউল আজম বলেন, “তাদের প্রস্তাবনা নিয়ে আমাদের আর্থিক ও কারিগরি বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। আমরা শিগগির মূল্যসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো সম্পর্কে মতামত তাদের কাছে পেশ করব।”
বিমান কেন বোয়িংয়ের পরিবর্তে এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কিনতে যাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী সোমবার বেনারকে বলেন, “বোয়িংকে বিমানের বহর থেকে বাদ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।”
তিনি বলেন, “বোয়িং হলো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো বেসামরিক উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। আমাদের বিমানের বহরে প্রায় সবই বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ। এখন সরকার ভালো মূল্যে ভালো মানসম্পন্ন আরও উড়োজাহাজ কিনতে চায়।”
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, “এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এয়ারবাস কোম্পানি থেকে উড়োজাহাজ কিনতে চায় সরকার। এখন মুক্ত বাজার, যেখান থেকে ভালো মূল্যে ভালো মানের উড়োজাহাজ কেনা যাবে সেখান থেকেই কেনা হবে।”
তিনি বলেন, “এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনার অর্থ এই নয় যে, আমরা বোয়িং থেকে সরে যাচ্ছি। সরকার এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।”
বেসামরিক বিমান বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল আলম সোমবার বেনারকে বলেন, “প্রকৃতপক্ষে সরকার একটি কোম্পানির ওপর নির্ভর না করে বৈচিত্র্য আনতে চায়। সরকার কেবলমাত্র বোয়িংয়ের ওপর নির্ভরতা রাখতে চায় না। সে কারণেই এয়ারবাস কোম্পানির উড়োজাহাজ কিনছে বিমান। এয়ারবাসও এই সুযোগ নিয়েছে।”
তিনি বলেন, “২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমানের বাজার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
ওয়াহিদুল আলম বলেন, “ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিমানে চলাচলকারী যাত্রীর সংখ্যা ১৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।”
তিনি বলেন, “বিমান যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাদের কমপক্ষে ৩০টি উড়োজাহাজ কিনতে হবে। সুতরাং, বাংলাদেশে উড়োজাহাজ ব্যবসার বিরাট সুযোগ রয়েছে। এই বাজার ধরতে বোয়িং এবং এয়ারবাস দুই কোম্পানিই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমশের মবিন চৌধুরীর মতে, মাখোঁর এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান।
তিনি বলেন, “যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দেশ মনে করে ইউক্রেনে যুদ্ধ সব আন্তর্জাতিক আইন; বিশেষ করে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। এই যুদ্ধ আইনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি। এছাড়া, এই যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে যে মারাত্মক পরিণতির সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে দুই দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।”
শমশের মবিন চৌধুরী বলেন, “এই অংশ এই জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, দুই দিন আগে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে গেছেন। এই সফরের পরেই রাশিয়ার বিপক্ষে যায় এমন বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। এর অর্থ হলো রাশিয়ার অবস্থানের সঙ্গে একমত নয় বাংলাদেশ।”
ইন্দো-প্যাসিফিক প্রসঙ্গ
যৌথ বিবৃতিতে ফ্রান্সকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বাসিন্দা বর্ণনা করে বলা হয়, ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আইন আনক্লজের আওতায় এই দুই সমুদ্র অঞ্চলকে সবার জন্য উন্মুক্ত নিরাপদ, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে সমমনা সব রাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স।
শমশের মবিন চৌধুরী বলেন, “মাখোঁ ফ্রান্সকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাসিন্দা বলেছেন। এর কারণ এই দুই মহাসাগরে ফ্রান্সের অধীনে কিছু ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। তিনি বহিঃশক্তি হিসেবে চীনকে বোঝাতে চেয়েছেন। এই দুই মহাসাগরে চীনের প্রভাব তারা গ্রহণ করতে পারবেন না। সে কারণে ফ্রান্স অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চায়।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ সোমবার বেনারকে বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, যৌথ বিবৃতিতে ইনক্লুসিভ শব্দ যোগ করা হয়েছে বাংলাদেশের কারণে। বাংলাদেশ এই ইনক্লুসিভ শব্দ দিয়ে তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য আনবে।”