বাংলা একাডেমিতে স্টল না পেয়ে আদর্শ প্রকাশনীর প্রতিবাদ, উন্মুক্ত বই প্রদর্শনী
2023.02.06
ঢাকা ও কলকাতা
সরকারের সমালোচনা করে লেখা বই প্রকাশের অভিযোগে বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল বরাদ্দ না পেয়ে ঢাকায় এককভাবে ‘উন্মুক্ত বইমেলা’ আয়োজন করেছে আদর্শ প্রকাশনী।
বাংলা একাডেমি স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা দেখা গেছে লেখক-পাঠক ও প্রকাশকদের ভেতরে। সমালোচনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে।
আদর্শকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়া নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় জানুয়ারির মাঝামাঝিতে। সে সময় ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আদর্শ প্রকাশনীর কর্ণধার মাহাবুব রহমান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সংস্থা থেকে প্রকাশিত তিনটি বইয়ে সরকারবিরোধী মত রয়েছে বলে গ্রন্থমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা সংবিধানবিরোধী এবং মুক্ত মত প্রকাশের পথে মারাত্মক বাধা।”
লেখক জিয়া হাসানের ‘উন্নয়ন বিভ্রম’, ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’ এবং ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ এই তিনটি বইয়ের কারণে বাংলা একাডেমি আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে বলে জানিয়েছিলেন মাহাবুব।
এসব বিতর্কের মধ্যে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংস্থাটির আপত্তি মূলত ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটিকে নিয়ে। এই বইটির লেখক ফাহাম বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মেয়ের জামাই।
বাংলা একাডেমি ২২ জানুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩ পরিচালনা কমিটি ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটি পড়ার পর একে বইমেলার ‘নীতিমালা ও নিয়মাবলী’ এর আলোকে শর্তাবলী পূরণে সক্ষম নয় বলে গণ্য করেছে।
এতে আরও বলা হয়, বইটিতে বাঙালি জাতিসত্তা, বিচার বিভাগ, বিচারপতি, দেশের সংবিধান, সংসদ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে “অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে”।
কলকাতাতেও প্রদর্শিত হচ্ছে না বইটি
‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটি কলকাতা বইমেলায় আনা হলেও প্রকাশক সমিতির নির্দেশে বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
কলকাতায় ৪৬তম আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আদর্শ প্রকাশনীর স্টল থাকলেও শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির নির্দেশের পর বইটির বিক্রি ও প্রদর্শন বন্ধ রাখা হয়েছে।
“বইটি থাকলেও আমরা তা প্রদর্শন করছি না, বিক্রিও করছি না। কী কারণে সমিতি বইটির প্রদর্শন ও বিক্রি না করার নির্দেশ দিয়েছে তা জানি না। বইটি সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি,” বেনারকে বলেন কলকাতা বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম পলাশ।
কলকাতা বইমেলার আয়োজক ‘পাবলিশার্স ও বুক সেলার্স গিল্ড’ এই নির্দেশ সম্পর্কে সরকারিভাবে অবগত নয় জানিয়ে সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “আমরা কোনো প্রকাশনী সংস্থার বই প্রদর্শন ও বিক্রি বন্ধ রাখতে বলিনি। আমাদের কাছে কোনো অনুরোধও আসেনি।”
তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বই নিয়ে কোনো বিধি-নিষেধ কখনোই কাম্য নয়।”
কলকাতা বইমেলা শুরুর আগে গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এক চিঠির মাধ্যমে আদর্শ প্রকাশনীকে আলোচিত বইটি প্রদর্শন না করার কথা জানায়।
ওই চিঠি সম্পর্কে সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল বেনারকে বলেন, “বইটি নিয়ে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার আপত্তির ভিত্তিতে বাংলা একাডেমি এটিকে নিষিদ্ধ করে। এই বইটি কলকাতায় প্রদর্শিত হলে আদর্শের সমস্যার পাশাপাশি আমাদের জন্যও বিব্রতকর হতে পারে বলে আমরা এই চিঠি দিয়েছি।”
তিনি আরও বলেন, “কলকাতা বইমেলায় যেহেতু বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের দায়িত্বে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, সেহেতু সমিতিকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়েছে।”
তবে কলকাতা বইমেলার শুরুতেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের উপহাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস জানান, “বাংলাদেশের কোনো বই বিক্রি ও প্রদর্শনে কোনো বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে কি না তা আমরা জানি না।”
প্রতিবাদ দেশে-বিদেশে
গত ১ জানুয়ারি নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান উপমুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতি আমাদের অবস্থান সবার উপরে।
একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়া প্রসঙ্গে ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্যাটেল বলেন, “আমরা সব সময়ই গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করে যাচ্ছি। এগুলোই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।”
মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ঢাকায় কথা বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস।
রোববার একটি অনুষ্ঠানে হাস বলেন, “সমালোচনা গ্রহণ করার সক্ষমতা এবং অপ্রীতিকর বক্তব্য হলেও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা শক্তিশালী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।”
গত জানুয়ারি মাসে একটি যুক্ত বিবৃতিতে বাংলা একাডেমির এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন ৫৯ জন নাগরিক।
বিবৃতিতে বলা হয়, “কোনো রকম নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এভাবে আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী।”
সাড়া পেয়েছে ‘উন্মুক্ত মেলা’
আদর্শ’র স্বত্বাধিকারী মাহাবুব বেনারকে জানান, উন্মুক্ত মেলায় তিনি বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছেন পাঠকদের কাছ থেকে।
তিনি আরও জানান, বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছেন, যেটির শুনানি মঙ্গলবার হতে পারে।
“আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার বিশ্বাস আদালতের রায়ে হলেও মেলায় স্টল পাবে আদর্শ,” বলেন মাহাবুব।
একুশে বইমেলা থেকে এক কিলোমিটার দূরে ঢাকার কাঁটাবন এলাকায় প্রকাশনীটির কার্যালয়ে ও অনলাইনে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া আদর্শের ‘মুক্ত বইমেলা’র প্রদর্শনীটি চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।