সাংবাদিক রোজিনা কারাগারে: রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি চেষ্টার অভিযোগ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর
2021.05.18
ঢাকা
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের পরদিন কারাগারে পাঠিয়েছে বাংলাদেশের একটি আদালত।
রোজিনা ইসলাম দৈনিক প্রথম আলোতে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত। দৈনিকটির দাবি, স্বাস্থ্য বিভাগ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কারণেই আক্রোশের শিকার হয়েছেন তিনি। অন্যদিকে রোজিনার বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়ার সাথে করোনাভাইরাসের টিকা আমদানি সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি চুরির চেষ্টার অভিযোগ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
ওই নথিগুলো প্রকাশ হলে দেশের ক্ষতি হতে পারত বলে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
“একটি রুম থেকে তিনি সরকারি ফাইল নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেগুলোর ছবি তুলছিলেন। এগুলো রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয়,” জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এই ফাইলগুলো ছিল টিকা সংক্রান্ত। আমরা যে রাশিয়ার সাথে টিকার চুক্তি করছি, চায়নার সাথে টিকার চুক্তি করছি। সেগুলো নন ডিসক্লোজার আইটেম। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বলেছি, আমরা এটা গোপনে রাখব, এগুলো বলব না।”
“সেইগুলো যদি বাইরে চলে যায়, তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলাম, এবং আমরা টিকা নাও পেতে পারি। এতে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতি হতে পারে। এগুলো সিক্রেট ডকুমেন্ট, বাইরে যাওয়া ঠিক হয় নাই,” বলেন জাহিদ মালেক।
মঙ্গলবার রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে রোজিনার মুক্তির দাবি জানিয়ে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়।
এতে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, “রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে রিপোর্ট করছিলেন। এসব রিপোর্টের কারণে যারা বিক্ষুব্ধ হয়েছে, তাদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন রোজিনা ইসলাম।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য নানা সময়ে আলোচিত হয়েছেন রোজিনা। এসব প্রতিবেদনে দুর্নীতির অনেক চিত্র সামনে এসেছে।
তাঁর ওই প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে ছিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি নিয়োগে বড়ো অঙ্কের ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন, সরকারি আইন ও বিধি না মেনে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) গত বছর প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষাসামগ্রী কেনার ওপর প্রতিবেদন।
এছাড়া করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও রোগীর চিকিৎসায় জরুরি সামগ্রী কেনাকাটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) সমন্বয়হীনতা এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অফিস না করা সম্পর্কিত প্রতিবেদন।
তাঁর এমন সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের আলোকে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে সরকার।
নির্যাতনের অভিযোগ
মানববন্ধনে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও লেখক আনিসুল হক বলেন, “পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ওপর শারীরিক ও মানসিক হেনস্তা করা হয়েছে।”
তবে রোজিনা ইসলামকে ‘নির্যাতন করা হয়নি’ দাবি করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, “সাংবাদিক নিজেই মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সোমবার সচিবালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে যাবার পর রোজিনা ইসলামকে “পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রেখে হেনস্তা করা হয়” বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় প্রথম আলো।
রোজিনা ইসলাম সাম্প্রতিককালে “স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা” নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয় ওই বিবৃতিতে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, রোজিনার গলা চেপে ধরেন সচিবালয়ের এক নারী কর্মকর্তা। অন্য এক ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি অসুস্থ হয়ে মেঝেতে পড়ে যান। এর পর রাত আটটার দিকে সচিবালয় থেকে রোজিনা ইসলামকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।
রাতেই পুলিশ জানায়, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ। মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নথি চুরি এবং অনুমতি ছাড়া সেই নথির ছবি তোলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী কেউ অভিযুক্ত হলে তাঁর সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
আমার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে: রোজিনা ইসলাম
সোমবার রাতে শাহবাগ থানা হাজতে রেখে মঙ্গলবার সকালে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে রোজিনাকে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। অন্যদিকে জামিনের আবেদন জানান রোজিনার আইনজীবী।
তবে দুই আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠান বিচারক বিচারক মোহাম্মদ জসীম।
আদালতে রোজিনার জামিন আবেদনের আংশিক শুনানি হয়েছে জানিয়ে তাঁর আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বেনারকে বলেন, পরবর্তী শুনানি বৃহস্পতিবার।
রোজিনার বিরুদ্ধে “উদ্দেশ্যমূলকভাবে” মামলা করা হয়েছে জানিয়ে এহসানুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “মামলার এজাহারে যে ডকুমেন্টের কথা বলা হয়েছে, তার কোনো বর্ণনা এজাহারে নেই।”
“আদালতে হাজির করা জব্দ তালিকায় দেখা গেছে, ডকুমেন্টগুলো আসামির কাছ থেকে নয় বরং একজন সরকারি কর্মকর্তা নিজেই উপস্থাপন করেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মানহানিকর এবং আপত্তিকর,” বলেন তিনি।
শুনানি শেষে আদালত থেকে কারাগারে যাবার পথে পুলিশি পাহারার মধ্যেই রোজিনা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়ে রিপোর্ট করায় আমার সঙ্গে অন্যায় করা হচ্ছে।”
সাংবাদিক সমাজের বিক্ষোভ
রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবি জানিয়ে দিনভর বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে সাংবাদিক সমাজ। তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা।
“পেশাদার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার, হেনস্তা ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা অত্যন্ত দুঃখজনক। অনভিপ্রেত। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন।
তাঁর মতে, “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে হলে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ করতেই হয়। তাই বলে তথ্য চুরির অপবাদ কোন আইনে পড়ে আমি জানি না। আমার মনে হয় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে।”
রোজিনার বিরুদ্ধে আনা ‘ভিত্তিহীন’ মামলা প্রত্যাহারসহ তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “সচিবালয়ের রুমে যারা তাঁকে হেনস্তা করেছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।”
সোমবার এক বিবৃতিতে অবিলম্বে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবি জানিয়েছে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করা নিউইয়র্কভিত্তিক সংগঠন দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।
পৃথক বিবৃতিতে এই ঘটনাকে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
রোজিনা ইসলামের উপর ঘটে যাওয়া ঘটনাকে “উদ্বেগজনক, মুক্ত ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর চরম আঘাত,” হিসেবে উল্লেখ করে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তাঁর মুক্তির দাবি জানায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ)।
এছাড়া রোজিনাকে হেনস্তা করার প্রতিবাদে তাঁকে কেন্দ্র করে কী ঘটেছে তার বিস্তারিত জানাতে মঙ্গলবার সকাল ১১ টার দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডাকা এক সংবাদ সম্মেলন বয়কট করে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএইচআরএফ)।
এক বিবৃতিতে রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার ও অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি জানিয়ে তাঁর আক্রান্ত হওয়ার কারণ তলিয়ে দেখা ও হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তাঁদের কর্মকাণ্ডের তদন্তের দাবি জানিয়েছেন দেশের ১১ বিশিষ্ট নাগরিক।