মুক্তির দাবি অব্যাহত, কিন্তু জামিন হয়নি সাংবাদিক রোজিনার
2021.05.20
ঢাকা

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে গ্রেপ্তার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ চললেও তাঁর জামিন হয়নি, এ বিষয়ে আদেশ দিতে রোববার তারিখ দিয়েছে আদালত।
বৃহস্পতিবার তাঁর জামিন আবেদনের ওপর অনলাইন শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত দেন ঢাকার মহানগর হাকিম বাকী বিল্লা। বেনারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রোজিনার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী।
এদিকে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা সকল দমনমূলক অভিযোগ তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও (এইচআরডব্লিউ)।
দিনভর বিভিন্ন সমাবেশ থেকে অবিলম্বে রোজিনা ইসলামকে নিঃশর্তে মুক্তির দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। পেশাদার এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারসহ তাঁকে হেনস্তা ও হয়রানির ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত শাস্তি দাবির পাশাপাশি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবিও জানান তাঁরা।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সোমবার সচিবালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে গেলে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরি এবং ছবি তোলার অভিযোগে এক কর্মকর্তার কক্ষে রোজিনা ইসলামকে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় আটকে রাখা হয়।
পরে রাতে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। ১৯২৩ সালের এই আইন অনুযায়ী কেউ অভিযুক্ত হলে তাঁর সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
গ্রেপ্তারের পরদিন মঙ্গলবার আদালত রোজিনাকে কারাগারে পাঠায়। সেদিন রোজিনা জামিন আবেদন করলে সেটার শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে আদালত।
রোজিনা ইসলাম দৈনিক প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত। মঙ্গলবার প্রথম আলো এক বিবৃতিতে জানায়, রোজিনা ইসলাম সাম্প্রতিককালে “স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা” নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন।
জামিন মৌলিক অধিকার: আইনজীবী
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আদালতে অনলাইন শুনানি করা হয়, এসময় সরকার এবং রোজিনার পক্ষের আইনজীবীরা তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে এ বিষয়ে রোববার আদেশ দেওয়া হবে বলে জানায় আদালত।
শুনানিতে রোজিনা ইসলামের মামলাটি জামিনযোগ্য উল্লেখ করে তাঁর আইনজীবী এহসানুল হক বলেন, “জামিন পাওয়াটা তাঁর মৌলিক অধিকার।”
তবে রোজিনার জামিনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন বলেন, “আসামির কাছ থেকে আলামত উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁকে জামিন দেওয়া ঠিক হবে না।”
ভার্চুয়াল শুনানি হওয়ায় রোজিনাকে আদালতে আনা হয়নি। তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে রাখা হয়েছে।
গণমাধ্যমের ওপর চরম আঘাত
রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তার গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত এবং তা বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানরত অন্যান্য সাংবাদিকদেরও একটি ভীতিকর বার্তা দিচ্ছে বলে বৃহস্পতিবারের বিবৃতিতে জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা সকল দমনমূলক অভিযোগ তুলে নেয়ারও দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত, হয় রোজিনা ইসলামের অপরাধ প্রমাণ করা অথবা তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়া এবং দেশের সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে দেয়া।”
“সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে রাখার পরিবর্তে মহামারি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কৌশলের অংশ হিসেবেই মুক্ত গণমাধ্যম চর্চা চালু রাখা উচিত,” বলেন ব্র্যাড অ্যাডামস।
রোজিনার মুক্তির দাবি জানিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর (আরএসএফ) এশিয়া-প্যাসিফিক ডেস্কের প্রধান ড্যানিয়েল বাস্টার্ড বলেন, “তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো খুবই বিস্ময়কর। কারণ এগুলো স্পষ্টভাবেই খুব অপরিপক্কভাবে সাজানো। এতে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা বিপন্ন হচ্ছে।”
এছাড়া সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট-সিপিজে রোজিনার মুক্তির দাবি জানিয়েছে। বাংলাদেশের এই পেশাদার সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ মঙ্গলবার বলেছে, সাংবাদিকদের হয়রানিমুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
বিশ্বজুড়ে এমন প্রতিক্রিয়ার মুখে রোজিনার গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ‘দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসাবে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কখনো আপনাদের নিষেধ করি না। আমাদের কোনো কিছু লুকানোর নেই। যে ঘটনা ঘটছে, খুব দুঃখজনক ঘটনা।”
তবে এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, “রোজিনাও ভুল করে থাকতে পারেন। কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, এটা মাথায় রাখতে হবে।”
বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর বাসভবনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) সদস্যরা এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে “বিষয়টিকে ইমোশনালি না দেখে বাস্তবতার নিরিখে বিচারের” আহ্বান জানান তথ্যমন্ত্রী।
বিক্ষোভ অব্যাহত
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “রোজিনা ইসলাম সত্য প্রকাশ, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতীক।”
“তিনি যে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, সেটি তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়, সেটি জনগণের তথ্য। তাই চৌর্যবৃত্তির যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেটি বা অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট জনগণের অবাধ তথ্য পাওয়ার অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক,” বলেন তিনি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, রোজিনা ইসলামকে যে ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে, তা সভ্য দেশে হতে পারে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এভাবে কোনো সাংবাদিককে আটকে রাখতে পারে না।”
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “একটা নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করতে হবে, যেখানে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিরা থাকবেন, কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ থাকবেন না।”
ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান বলেন, “উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। এসব নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।”
সাংবাদিকদের পাশাপাশি রোজিনা ইসলামের মুক্তি ও তাঁকে হেনস্তাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ–সমাবেশ করেছেন।