সংস্কারে পিছিয়ে ২০ শতাংশ পোশাক কারখানা, অগ্নি নিরাপত্তা ত্রুটিই বেশি
2024.04.30
ঢাকা
রানা প্লাজা ধসের পর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার ২০ শতাংশই এখন পর্যন্ত সংস্কার কাজ শেষ করতে পারেনি।
সরকারি ও বেসরকারি হিসেবে, এমন কারখানার মোট সংখ্যা অন্তত সাতশ’, যেগুলোর বেশিরভাগই অগ্নি নিরাপত্তা সংক্রান্ত ত্রুটি সংশোধনে পিছিয়ে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বুধবার বিশ্বব্যাপী পালিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। দিবসটি সামনে রেখে এক বিবৃতিতে পোশাক শ্রমিকদের ভয়ভীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।
রানা প্লাজা ধসে ১১ শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে ২০১৩ সালে ইউরোপ ও আমেরিকার ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকির উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু ১১ বছর পর দেখা গেছে, প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কারখানার সংস্কার অগ্রগতি ৯০ শতাংশের নিচে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
অন্যতম কারণ আর্থিক সংকট
বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান এবং সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, সংস্কার সফল না হওয়ার অন্যতম কারণ আর্থিক সংকট।
এছাড়া রয়েছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সংস্কার সংক্রান্ত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নিয়ম নিয়ে পক্ষগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য।
সংস্কারে পিছিয়ে থাকা কারখানাগুলোর মালিকদের নিয়ে মঙ্গলবার বৈঠক করে মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), যেখানে মালিকপক্ষ সংস্কারে পিছিয়ে থাকার দায় দিয়েছে দেখভালকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বিজিএমইএ সভাপতি এস এম মান্নান কচি বেনারকে বলেন, “কিছু কারখানা পিছিয়ে আছে। কারখানা মালিকরা বলেছেন, এর কারণ হলো নতুন নতুন নিয়মকানুন দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে, অনভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের এসব কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। ”
“আবার কিছু হলেই বিদেশি বায়ারের কাছে কারখানার তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) বর্তমানে প্রায় ৪০০ পোশাক কারখানার সংস্কারকাজ তদারক করছে।
ডিআইএফই’র মহাপরিদর্শক মো. আব্দুর রহিম খান বেনারকে বলেন, “৩০ শতাংশ কারখানার সংস্কার কাজ সঠিক পথে রয়েছে।”
এর অর্থ হলো বাকি প্রায় ২৮০টি কারখানা পিছিয়ে রয়েছে।
কারখানাগুলোর “আর্থিক সংকট” পিছিয়ে থাকার মূল কারণ বলে জানান তিনি।
রাজধানীর বাড্ডায় অবস্থিত আর টেক্স ফ্যাশন্স লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিপন ভূঁইয়া বেনারকে বলেন, “আর্থিক সমস্যা আছে। একেকটা কারখানা সংস্কারে ৬০ লাখ টাকা লাগে। বড়ো কারখানায় আরো বেশি।”
“এর মধ্যেই শ্রমিকের বেতন বেড়েছে, কিন্তু পোশাকের বাড়তি দর পাচ্ছি না,” বলেন তিনি।
তবে তিনি দাবি করেন, তাঁর কারখানায় কোনো সমস্যা নেই।
সংস্কারের গতি কমেছে: শ্রমিকপক্ষ
দীর্ঘ সময়েও বাংলাদেশের পোশাক খাতের এতগুলো কারখানা ত্রুটিমুক্ত করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেছে শ্রমিক পক্ষগুলো। গত দুই-তিন বছরে সংস্কারের গতি কমে আসার অভিযোগও করছেন তারা।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজার পর অ্যাকর্ড এলায়েন্সের উদ্যোগে কারখানার নিরাপত্তা রক্ষায় যেভাবে কাজ করা হতো এবং যতটা গুরুত্ব ছিল, তা বর্তমানে বেশ কমে এসেছে।”
“এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে যেসব কারখানার সংস্কার কাজ তদারকি করা হচ্ছে, সেখানে অবস্থা আরো খারাপ। এভাবে চলতে থাকলে পোশাক খাতের সংস্কার গতি হারাবে। ফলে ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে।”
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে মোট দুই হাজারের বেশি কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রাথমিক পরীক্ষা করে সংস্কারের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে সময় ঠিক করে দেওয়া হয়।
এর পর ধীরে ধীরে উন্নত হতে শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। উভয় দল ২০২০ সালের শুরুর দিকে তাদের কাজ গুটিয়ে নেয়।
এর পর অ্যাকর্ডের আওতায় থাকা কারখানাগুলো সংস্কারের দায়িত্ব নেয় আরএসসি, যেখানে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক প্রতিনিধি ছাড়াও মালিকপক্ষও যুক্ত হয়। এর আওতায় ১ হাজার ৮শ’ কারখানার সংস্কার তদারক করা হচ্ছে।
এর বাইরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতায় বর্তমানে প্রায় ৪০০ কারখানার সংস্কার তদারক করা হচ্ছে।
শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ওই বছরই তুং হাই সোয়েটার ও আসওয়াদ কম্পোজিট নামে দুটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জন নিহত হন।
এর পর গত ২০২২ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আরো অন্তত ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে অন্তত ১৮ জন নিহত হন।
তবে এই সংখ্যা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগের সময়ের তুলনায় অনেক কম।
বিলসের তথ্য বলছে, ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সাত বছরে পোশাক কারখানায় বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ৫৪৮ শ্রমিক।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “অ্যাকর্ড চলে যাওয়ার পর সংস্কার কাজের গতি ও স্বচ্ছতা কমেছে।”
“এভাবে চলতে থাকলে আমরা শঙ্কিত, ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা আবার বাড়তে পারে,” যোগ করেন তিনি।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার এস্ট্রো নিটওয়্যার লিমিটেডের ৫০০ শ্রমিক ভাড়া ভবনে কাজ করেন।
২০১৮ সাল থেকে সংস্কার কাজ শুরু হওয়ার পর গত ছয় বছরেও অগ্নি নিরাপত্তার সংস্কার কাজ শুরুই করতে পারেনি।
এত দেরি হওয়ার জন্য দায়ী করা হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অবহেলাকে।
কারখানার মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক সমর চন্দ্র বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “পরামর্শকের (যারা সংস্কার কাজ তদারকের দায়িত্বে) কিছুটা অবহেলা ছিল, সেজন্য দেরি হয়েছে। আমাদের সংস্কার কাজের পরিকল্পনা দ্রুত অনুমোদন হলেই কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে।”
অগ্নি নিরাপত্তা অগ্রগতিতে সবচেয়ে পিছিয়ে
বর্তমানে আরএসসি’র অধীনে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে।
আরএসসি’র তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্নি নিরাপত্তার সব ত্রুটি সংশোধন করতে পেরেছে এক চতুর্থাংশ কারখানা।
তবে ভবনের কাঠামো ও বৈদ্যুতিক ত্রুটি সংশোধন হয়েছে ১২শ’র বেশি কারখানার।
আরএসসি’র ব্যবস্থাপনা বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে থাকা আমিরুল হক আমিন বেনারকে বলেন, “বর্তমানে সংস্কারের গতি কিছুটা ধীর।”
তবে এ জন্য মালিকপক্ষের প্রতিনিধি নিজেদের উপর দায় চাপাতে নারাজ।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি এবং আরএসসি’র বোর্ড সদস্য মিরান আলী বেনারকে তিনি বলেন, “স্টিলের কাঠামোর ভবনের ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান বিধান নিয়ে একটি অস্পষ্টতা রয়েছে। এজন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছি।”
তিনি বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে আমাদের নিয়ম আন্তর্জাতিক বিধানের সঙ্গে মেলে না। তবে আশা করছি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখব।”
মামলা ও ভয়ভীতি বন্ধের আহ্বান অ্যামনেস্টির
মে দিবস সামনে রেখে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে মামলা দিয়ে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি।
বিবৃতিতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বেআইনি শক্তি প্রয়োগ এবং কর্মক্ষেত্রে আঘাত এবং মৃত্যুর জন্য দায়মুক্তির সংস্কৃতির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, ন্যায়বিচার, মজুরি, পর্যাপ্ত সুরক্ষা এবং কাজের পরিবেশে দাবিতে তারা সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা হয়রানি, ভয়ভীতি এবং সহিংসতাসহ নানারকম বাধার সম্মুখীন হন।
“আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে শ্রমিকদের অধিকারের দমন-পীড়ন বন্ধ করার জন্য এবং প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই কারখানা পর্যায়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও যোগদান করতে সক্ষম হওয়াসহ তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করছি,” জানান অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়ার উপ আঞ্চলিক পরিচালক নাদিয়া রহমান।