গাজীপুরে পাওনা নিয়ে কথা বলার পর প্রাণ হারালেন শ্রমিক নেতা
2023.06.26
ঢাকা
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গাজীপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিকদের অসন্তোষের মধ্যে এক শ্রমিক নেতাকে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পোশাক শিল্প এলাকাগুলো। হত্যার প্রতিবাদে অন্তত তিনটি এলাকায় শ্রমিকেরা বিক্ষোভে করেছেন বলে জানা যায়।
রোববার রাতে (২৫ জুন) শহিদুল ইসলাম নামে এই শ্রমিককে হত্যার ঘটনা ঘটে। নিহত শ্রমিক শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের (বিজিআইডব্লিওএফ) গাজীপুর অঞ্চলের সভাপতি ছিলেন। এই সংগঠনের সভাপতি কল্পনা আক্তার সোমবার শহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন।
কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “মালিকপক্ষের লোকেরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমরা হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।”
নিহত শহিদুল ইসলাম গাজীপুরে প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড নামে একটি কারখানায় কর্মরত ছিলেন। এ বিষয়ে কারখানার ওয়েবসাইটে দেওয়া নম্বরে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সাইফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
শহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তকে রবিবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ওসি শাহ আলম বলেন, “গার্মেন্টসের মালিক শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছিল না। পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে তিনি (শহিদুল ইসলাম) সেখানে গিয়েছিলেন।”
শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার কারখানাতে ৭৫০ শ্রমিক কাজ করলেও সেখানে কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল না।
যেভাবে হত্যা করা হয়
শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় করা মামলার এজাহারের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। এতে ৬ আসামিসহ আরো অজ্ঞাতনামা অন্তত ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে কারখানার ম্যানেজার হানিফের নামও উল্লেখ রয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, “…শহিদুল ইসলাম শ্রমিকদের মে মাসের বেতন, ঈদুল আজহার বোনাস ও জুন মাসের বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ চলমান থাকাকালে পাওনা আদায় করে দেওয়ার লক্ষ্যে কারখানাটিতে যান।”
“তিনি কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানান, তারা সোমবার (২৬ জুন) টঙ্গি পশ্চিম থানা এলাকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে (ডিআইএফই) যাবেন। এরপর কারখানা থেকে বের হওয়ার সময় ‘শ্রমিকদের বেতন দিতে আইছস’-- বলে তাঁর বুকে উপর্যুপরি ঘুষি মেরে নিস্তেজ করে ফেলা হয়,” এজাহারে বলা হয়।
এরপর শহিদুল ইসলামকে স্থানীয় তায়রুন্নেসা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ, ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শ্রমিক নেতা হত্যার পর রবিবার গভীর রাতেই তাইরুন্নেসা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে গাজীপুর-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা।
সোমবার প্রায় ২০টি শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) গাজীপুরে জেলা প্রশাসক অফিসের সামনে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করে। শিল্প অধ্যুষিত নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে বলে বেনারকে জানান আইবিসি’র সাধারণ সম্পাদক কুতুবুদ্দিন আহমেদ। আশুলিয়াতেও শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে বলে জানান আইবিসি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ।
প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডের মালিকের ‘গুণ্ডা বাহিনী’ শহিদুল ইসলামকে হত্যা করেছে বলে এক বিবৃতিতে দাবি করেছে আইবিসি।
সংগঠনটি মঙ্গলবার (২৭ জুন) ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারসহ দেশের সব গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় বিক্ষোভ আহবান করা হয়েছে।
এদিকে শহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র। এই সংগঠনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “পরিকল্পিতভাবে হামলা করে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে হত্যা নীল নকশার অংশ।”
দুই শ্রমিক সংগঠনের বিরোধ, বলছে মালিকপক্ষ
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বেনারকে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে মালিকপক্ষের সংশ্লিষ্টতা নেই। শ্রমিক পক্ষের নেতাদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। তিনি (নিহত শ্রমিক নেতা) অসুস্থ ছিলেন। ঘটনাটি কারখানার মধ্যেও ঘটেনি। কারখানার বাইরে হয়েছে।”
কারখানায় অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য মাঝে মাঝেই এমন ঘটনা ঘটানো হয় বলেও অভিযোগ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি’ও বলেন, “নিহত শহিদুল ইসলামের উপর আরেক শ্রমিক ফেডারেশনের লোকজন হামলা করেছে।”
তবে শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার বলেন, “যখন ইয়েলো ইউনিয়ন (কারখানা মালিকের পক্ষের) সুযোগ পায়, তখন প্রকৃত শ্রমিক আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে। আগে এর শিকার হয়েছেন আমিনুল ইসলাম আর এবার হলেন শহিদুল ইসলাম।”
ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে বৈশ্বিক অঙ্গনে
বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে সমালোচনার মধ্যে নতুন এ ঘটনা পোশাক খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বেনারকে বলেন, “এর আগে ২০১২ সালে একজন শ্রমিক নেতা (আমিনুল ইসলাম) হত্যার পর সরকারকে যথেষ্ট চাপে পড়তে হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অখুশি।”
নতুন করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা যাতে না হয়-- উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “পোশাক খাতের ভাবমূর্তির জন্যই সুষ্ঠু ও নির্মোহ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”