শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যা: স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত চায় এইচআরডব্লিউ
2023.07.06
ঢাকা
পোশাক শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম হত্যার স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এই দাবি জানায় সংগঠনটি।
গত ২৫ জুন রাত নয়টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর সাতাইশ বাগানবাড়ী এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলায় মো. শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ (৫০) নিহত হন।
শহীদুল হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র এবং জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। গত বুধবার রাজধানীর রামপুরায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয় পরিদর্শন করে পিটার হাস বলেন, “মামলাটির তদন্তে সার্বক্ষণিক নজর থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের।”
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের সময় এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি আলোচনায় স্থান পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী সপ্তাহে (১১ থেকে ১৪ জুলাই) উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের সময় মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বাণিজ্যসহ পারস্পরিক স্বার্থের অন্যান্য বিষয় আলোচনায় আসবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং এশিয়া বিষয়ক ব্যুরোর উপ-সহকারী প্রশাসক, ইউএসএআইডি অঞ্জলি কৌর প্রতিনিধিদলে থাকবেন।
অবহেলার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে
শহীদুলের মৃত্যুর পর দিন ২৬ জুন টঙ্গী পশ্চিম থানায় ছয় জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি কল্পনা আক্তার। আসামিদের পাঁচ জনই আরেকটি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
এ প্রসঙ্গে কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “খুনিরা শ্রমিক পরিচয়ে মূলত মালিকপক্ষের ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করেছে।”
এ ঘটনায় পুলিশ মাজাহারুল নামে এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। মাজাহারুল বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদক।
পুলিশের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ এনে কল্পনা বলেন, “পুলিশ এই মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে এবং তদন্তের ক্ষেত্রে অবহেলা দেখাচ্ছে।”
কল্পনা আক্তারের অভিযোগ সম্পর্কে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, “এই মামলাটি সম্পর্কে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। পুলিশ ইতোমধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তদন্ত সঠিকভাবেই এগোচ্ছে।”
শ্রমিক নেতা হত্যার ঘটনাকে সরকার খাটো করে দেখছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের সরকার বিচারহীনতার নীতিতে বিশ্বাসী না। এই ঘটনার অবশ্যই বিচার হবে।”
উল্লেখ্য, সাতাইশ বাগানবাড়ী এলাকার প্রিন্স জেকার্স সোয়েটার লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মে মাসের বেতন বকেয়া ছিল। ঈদের আগে জুন মাসের ১৫ দিনের বেতনসহ বোনাসের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করছিলেন।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, শ্রমিকদের পক্ষে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি শহীদুল ইসলাম মালিকপক্ষের সঙ্গে সেই রাতে কথা বলতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে হামলায় তিনি আহত হন এবং পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
শহীদুল হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা টঙ্গী পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক উৎপল কুমার বেনারকে বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এই মামলাটি তদন্ত করছি। কোনো ক্ষেত্রেই অবহেলা হচ্ছে না।”
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা বড়ো পরীক্ষা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাপকদের দ্বারা শ্রমিক ইউনিয়নবিরোধী কৌশল এবং ইউনিয়ন সংগঠকদের ওপর হামলাসহ গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকারের ক্রমাগত লঙ্ঘন বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকার এখনো ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই শ্রম অধিকার এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তায় জরুরি উন্নতির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ ইইউ অ্যাডভোকেট ক্লাউদিও ফ্রাঙ্কাভিলা বলেছেন, “শহীদুল ইসলামের জন্য ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড়ো পরীক্ষা হবে, কারণ বিশ্ব সবই দেখছে।”
“একজন শ্রমিক নেতার হত্যাকাণ্ড শ্রমিকদের সংগঠিত করার স্বাধীনতা এবং শ্রমিক বিরোধ সমাধানের জন্য ইউনিয়ন নেতাদের ভূমিকাকে বাজে রকম ধাক্কার মধ্যে ফেলল,” বলেন তিনি।
কারখানাটির মালিক হামলার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িতদের সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ইইউ যেহেতু তাদের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বাড়ানোর জন্য সরকারের অনুরোধ বিবেচনা করে, তাই ইইউ’র উচিত হবে শহীদুলের হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকারের অবস্থার ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচনা করা।
এই হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠকদের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষের নিপীড়নের একটি নতুন উদাহরণ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল একই ধরনের বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করার পর অন্য গার্মেন্টস ইউনিয়নের নেতা আমিনুল ইসলাম নিখোঁজ হন। দুই দিন পর তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এক দশকেরও বেশি সময় পরে উচ্চ পর্যায়ের দ্রুত তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুর তদন্তে পরিমাপযোগ্য অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হয়েছে, বলা হয় বিবৃতিতে।