বছরের শেষে শ্রমিকের মজুরি বাড়তে পারে, পোশাকেরও বাড়তি মূল্য চান রপ্তানিকারকরা

রিয়াদ হোসেন
2023.09.21
ঢাকা
বছরের শেষে শ্রমিকের মজুরি বাড়তে পারে, পোশাকেরও বাড়তি মূল্য চান রপ্তানিকারকরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২৩ হাজার টাকা ঘোষণার দাবিতে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নারীপক্ষ নামের একটি সংগঠনের মানববন্ধন। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

বছরের শেষ নাগাদ তৈরি পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে, তাই ক্রেতাদের বাড়তি দর দেবার অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা।

বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোকে এমন অনুরোধ জানিয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠিয়েছেন পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান।

চলতি বছরের শেষ নাগাদ পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা হতে পারে উল্লেখ করে চিঠিতে তিনি বলেন, এসময় আগের মজুরি ও গত পাঁচ বছরের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় শ্রমিকদের মজুরি “উল্লেখযোগ্য” হারে বাড়তে পারে।

তিনি জানান, আগামী পহেলা ডিসেম্বরে যেসব পোশাক উৎপাদন হবে, এখন থেকেই সেগুলোর দরাদরি হবে।

“শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ‘যৌক্তিক’ দর বাড়ানোর বিবেচনা করার অনুরোধ করছি,” বলেন ফারুক হাসান।

পোশাক খাত কঠিন পরিস্থিতি পার করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন তিনি।

বায়ার্স ফোরাম ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় করা সব ব্র্যান্ডকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান ফারুক হাসান। তবে এখনো চিঠির বিপরীতে বায়ারদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ থেকে এককভাবে সবচেয়ে বেশি পোশাক কেনে সুইডেনভিত্তিক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এ বিষয়ে জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ইমেইল পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জবাব পাওয়া যায়নি।

দাম বাড়ানো নিয়ে সংশয়

বাংলাদেশি পোশাকের বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঢাকার প্রতিনিধিদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) নেতারা নতুন করে দর বাড়ানো যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

বিজিবিএর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “অতীতে মজুরি বাড়ালে ক্রেতারাও দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে গেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। অনেক কারখানার ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়ে যাচ্ছে, আমরা (ক্রেতারা) বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।”

সর্বশেষ ২০১৮ সালে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ঘোষণা করা হয়। ওই বছর শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল; যা আগের মজুরির তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি ছিল।

বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পরপর শ্রমিকের নতুন মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করার বিধান রয়েছে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে তিন বছর পরে গঠন করার বিধানও রয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশের বেশি; যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।

মূল্যস্ফীতির কারণে নতুন মজুরির জন্য গত প্রায় দুই বছর ধরে শ্রমিকরা বিচ্ছিন্নভাবে দাবি জানিয়ে আসছেন।

শ্রমিকদের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বেনারকে জানান, গত ১০ এপ্রিল শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই খাতের শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে। ইতোমধ্যে বোর্ডের দু’টি সভা শেষ হয়েছে। আগামী ১ অক্টোবর পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে শ্রমিক পক্ষের ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব দেওয়া হবে।

২০ হাজার টাকা হতে পারে শ্রমিকদের প্রস্তাব

শিল্প ও শ্রমিকদের বর্তমান পরিস্থিতি দেখতে মজুরি বোর্ডের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারখানা পরিদর্শন করছে জানিয়ে রনি বলেন, “আমরা ন্যূনতম মজুরি কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেবো।”

যদিও শ্রমিকদের বড়ো একটি অংশ মজুরি ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছে।

এদিকে মালিকপক্ষ এখনো প্রস্তাব চূড়ান্ত করেনি বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি।

ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে—এমন সংগঠন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বেনারকে বলেন, “বর্তমান মূল্যস্ফীতির কারণে এই মজুরি আরও বেশি হওয়া উচিত।”

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) শ্রমিকের মজুরি কত হওয়া উচিত তার ওপর একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে গত জানুয়ারিতে প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে ঢাকার পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ২২ হাজার ৮৫০ টাকা করা যৌক্তিক বলা হয়েছে।

সবাই মূল্য বাড়ায় না

বায়াররা বর্ধিত দর কত দেবেন—বিজিএমইএ সভাপতি তা উল্লেখ না করলেও চিঠিতে ‘যৌক্তিক’ দর বাড়ানোর কথা বলেছেন।

“বাড়তি মজুরির কারণে পোশাকের উৎপাদন খরচ যে পরিমাণ বাড়ে, ব্যয় হিসাব করে অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই তা বহন করে। বিশেষত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো,” বেনারকে জানান বিজিএমইএ সহসভাপতি নাসির উদ্দিন।

এদিকে প্রতিটি পোশাকের মজুরির অংশ “সাধারণত সর্বোচ্চ সাত শতাংশ,” বলে বেনারকে জানান পোশাকের যৌক্তিক দর নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংগঠন ফেয়ার উইয়ার ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ অফিসের প্রধান বাবলুর রহমান।

তবে তিনি বলেন, “মজুরি বৃদ্ধির পর পোশাকের দর চূড়ান্ত করার সময় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা থাকলেও সবাই তা করে না।”

গত ২০১৩ ও ২০১৮ সালে মজুরি ঘোষণার পর কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওই বর্ধিত মূল্য দেয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “এবার শ্রমিক সংগঠন এবং আমরা এ বিষয়ে সোচ্চার।”

শ্রমিককে যেন ঠকানো না হয়

শ্রমিকের মজুরি বাড়ানো কারখানা মালিক ও ক্রেতা উভয়েরই দায়িত্ব বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার।

তিনি বলেন, “বায়ার দর বাড়ায়নি; এমন খোঁড়া অজুহাতে আমাদের কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি কম দিলে তা ন্যায্য হবে না।”

“মজুরি বোর্ড গঠনের ছয় মাসের মধ্যে মজুরি ঘোষণার কথা থাকলেও ইতোমধ্যে পাঁচ মাস পার হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকের জীবনমান আরও নিচে নেমে গেছে। আমরা অবিলম্বে মজুরি ঘোষণার দাবি জানাই,” বলেন জলি তালুকদার।

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে “রপ্তানিকারকরা আর্থিকভাবে লাভবান হলেও শ্রমিকের বেতন বাড়েনি,” বলে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত প্রায় দেড় বছরে ডলার বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, দেড় বছর আগে এক ডলারে রপ্তানিকারক ৮৫ টাকা পেতেন। এখন পাচ্ছেন ১১০ টাকা।

বাংলাদেশ অন্যতম কম মজুরির দেশ

বিলসের ‘আরএমজি সেক্টর মিনিমাম ওয়েজ: প্রপোজিশন ক্যালকুলেশন অ্যান্ড দ্য রেশনাল’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে নয়টি দেশের পোশাক খাতের নিযুক্ত শ্রমিকের মজুরির তুলনা করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, সবচেয়ে কম মজুরি এখনো বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ৭৫ দশমিক পাঁচ ডলার। একই সময়ে চীনে ২৬২ ডলার, ভারতে ১২৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩৭ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১৯৪ ডলার মালয়েশিয়ায় ২৫০ ডলার, ফিলিপাইনে ২৪৪ ডলার, ভিয়েতনামে ১৬৮ ও তুরস্কে ৩০৭ ডলার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।