মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের মহাসড়ক অবরোধ, কারখানা ভাঙচুর
2023.10.26
ঢাকা
পোশাক শ্রমিকদের জন্য মালিকপক্ষ মজুরি বোর্ডে বর্তমান ন্যুনতম মাসিক বেতন ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪০০ টাকা প্রস্তাবের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার গাজীপুরের পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের অসন্তোষ সহিংসতায় রূপ নেয়।
মাসিক কমপক্ষে বিশ হাজার টাকা ন্যুনতম মজুরি দাবি করে আসছেন শ্রমিকরা।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি, শফিপুর ও মৌচাক এলাকায় কয়েক হাজার হাজার শ্রমিক বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে পড়লে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও কারখানা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
বৃহস্পতিবার অন্তত ৫ হাজার শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন বলে বেনারকে জানান গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকবর আলী খান।
তবে শ্রমিকরা আগে পরে দলে দলে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভে নামায় মোট কত শ্রমিক বিক্ষোভ করেছেন তা বলা সম্ভব নয় বলে বেনারকে জানান শিল্পাঞ্চল পুলিশ গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মইনুর রহমান।
তিনি বলেন, “বেশকিছু গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। কারখানায়ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে।”
বিকেলের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত ইসলাম গার্মেন্টসের শ্রমিক হুমায়ুন কবিরও অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে আন্দোলনে নেমেছেন। বেনারকে তিনি বলেন, “আমাদের দাবি ২৩ হাজার টাকা মজুরি, কিন্তু মালিকপক্ষ দিতে চায় ১০ হাজার ৫০০ টাকা। এই টাকা দিয়ে কী করব?”
পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় নিজের পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হচ্ছে জানিয়ে ৪১ বছর বয়সী দুই সন্তানের পিতা হুমায়ুন বলেন, “যে মূলা কেউ খেতে চাইত না, সেটির কেজি এখন ৯০ টাকা, আর বেগুন ১০০ টাকা। সরকার বলেছে পেঁয়াজ বিক্রি হবে ৬০ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়- এভাবে কি চলা সম্ভব?”
দ্রুত শ্রমিকদের দাবি নেমে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “অন্যথায় আন্দোলন চলবে। বেতন না বাড়লে আমরা চলতে পারছি না।”
শিল্পাঞ্চল পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে ওই এলাকায় যানজট সৃষ্টি হয়।
ডলারের হিসাবে মজুরি ‘একটুও বাড়ছে না’
দেশের প্রধান রপ্তানিখাতের ৪০ লাখ শ্রমিক অধ্যুষিত এই খাতে এমন সময়ে অসন্তোষ দেখা দিলো, যখন মাত্র আড়াই মাস পরে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা।
নির্বাচনের ঠিক আগে মজুরি বাড়ার বিষয়টা ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও জানাচ্ছেন শ্রমিক নেতাদের কেউ কেউ।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সম্প্রতি বেনারকে বলেন, “৬ মাসের মধ্যে মজুরি ঘোষণা না করে নতুন করে তিন মাস সময় নেওয়া অযৌক্তিক। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনী ডামাডোল শুরু হয়ে যাবে এবং এতে করে হয়তো মজুরির বিষয়টি ঝুলে যাবে।”
শ্রম আইনে ৬ মাসের মধ্যে ন্যুনতম মজুরি ঘোষণার কথা থাকলেও গত ১০ আগস্ট বোর্ড গঠনের পর ওই সময় পার হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর মালিক ও শ্রমিকপক্ষ যথাক্রমে ১০ হাজার ৪০০ টাকা ও ২০ হাজার ৩৯৪ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, মালিকপক্ষের প্রস্তাব বিবেচনায় নিলে ডলারের অঙ্কে মজুরি একটুও বাড়ছে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “পাঁচ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশ। ফলে ডলারের হিসেবে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে না।”
“পাঁচ বছর আগে শ্রমিকরা প্রায় ৯৫ ডলার পেতেন, এখনও মালিকপক্ষের প্রস্তাব প্রায় একই। এই প্রস্তাব যৌক্তিক নয়,” বলেন তিনি।
শ্রমিক নেত্রী ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “মালিকপক্ষ এই প্রস্তাব দিয়ে শ্রমিকদের অসম্মান করেছে।”
দ্রুত মজুরি ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যৌক্তিক মজুরি ঘোষণা না হলে অসন্তোষের আশঙ্কা থাকবে।
এর আগে গত ১৩ অক্টোবর বিশ্বের খ্যাতনামা ১৩টি ব্র্যান্ড যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ জানায়। এতে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ব্যুরো’র হিসাব অনুযায়ী, গত প্রায় এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে।
এই প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়: মালিকপক্ষ
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতারা বৃহস্পতিবার বৈঠক করেছেন।
বৈঠক শেষে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন বেনারকে জানান, গাজীপুরের প্রায় ২০০ কারখানার শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসায় উৎপাদন হয়নি, “বাধ্য হয়ে কারখানাগুলো ছুটি দেওয়া হয়েছে।”
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ সভাপতি এস এম মান্নান কচি মনে করেন, কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই খাতকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে। বেনারকে তিনি বলেন, “এর আগেও মজুরির বিষয়ে উভয় পক্ষ প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের এই প্রস্তাবই তো চূড়ান্ত নয়। প্রতিবারই দরকষাকষি হয়। আলোচনার মাধ্যমে একটি যৌক্তিক জায়গায় আসে। তাহলে এবার কেন আন্দোলন করতে হবে?”
মালিকপক্ষের প্রস্তাব চূড়ান্ত নয় বলে মন্তব্য করেন মো. নাসির উদ্দিনও। তিনি বলেন, শ্রমিকদের দাবি থাকলে তাঁরা তা বলতে পারেন। এছাড়া মজুরি বোর্ডের ঘোষণা তাঁরা মেনে নেবেন বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, মজুরি বোর্ডের পরবর্তী সভা আগামী ১ নভেম্বর।