মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন, দুজন নিহত
2023.10.30
ঢাকা
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সপ্তম দিনের মতো বিক্ষোভকালে সোমবার অন্তত দুজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এদের একজন মারা গেছেন আগুনে পুড়ে।
নিহত শ্রমিকদের মধ্যে রাসেল হাওলাদার (২২) ডিজাইন এক্সপ্রেস কারখানায় কাজ করতেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক।
শ্রমিকরা পুলিশের গুলিতে রাসেলের নিহত হওয়ার কথা বললেও গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বেনারকে বলেন, রাসেলের “শরীরে জখমের চিহ্ন আছে। …ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে, তারাও পুলিশকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। ফলে কীভাবে মারা গেছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”
শ্রমিকদের ছোঁড়া ইটের আঘাতে দুইজন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে এবিএম ফ্যাশন লিমিটেডের কারখানায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আগুন দেবার পর ইমরানের (৩০) মৃত্যু হয় বলে গাজীপুর ফায়ার ব্রিগেডের প্রধান আব্দুল্লাহ আল আরেফিনের বরাত দিয়ে জানায় বার্তাসংস্থা এএফপি।
গাজীপুর ছাড়াও সোমবার আশুলিয়ায় সংঘর্ষ হয়েছে। দুই জায়গায় আহত হয়েছেন অন্তত ৩৭ জন শ্রমিক, এদের মধ্যে আশুলিয়ায় ২৭ জন এবং গাজীপুরে ১০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এবিএম ফ্যাশন্স আশুলিয়ায় পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দিয়েছেন।
এ ঘটনার পর আশুলিয়া এলাকার শতাধিক কারখানা সোমবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকারও বেশিরভাগ পোশাক কারখানা দুপুরের দিকে বন্ধ করা হয়।
বিকেলের দিকে আশুলিয়ার পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলেও গাজীপুরের পরিস্থিতি তখনো থমথমে ছিল বলে বেনারকে জানিয়েছেন কালিয়াকৈর এলাকায় অবস্থিত যমুনা ডেনিমস এর শ্রমিক মোহাম্মদ খোকন।
এদিকে গত সাত দিন ধরে চলা এ আন্দোলন গাজীপুরের কয়েকটি এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও তা শিল্প অধ্যুষিত আশুলিয়া ও ঢাকার মিরপুরেও ছড়িয়েছে বলে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন।
সোমবারের ঘটনায় আহতদের বেশিরভাগই স্থানীয় আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হারুন-অর রশিদ বেনারকে বলেন, “আহতদের ২৭ জন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা বেশি খারাপ থাকায় তাদের ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়েছে।”
বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ
শ্রমিকদের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্তকে ভুল বলে আখ্যায়িত করেছেন শ্রমিক নেতারা।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান মনে করেন শ্রমিকদের দমন করার সিদ্ধান্ত ভুল।
বেনারকে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ বা দমন-পীড়ন করলে তা বুমেরাং হবে, পরিস্থিতি আরো অগ্নিগর্ভ হবে।”
প্রসঙ্গত, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল ১৬টি পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠিত দেশের সর্ববৃহৎ শ্রমিক জোট।
আশুলিয়া এলাকায় বেশিরভাগ পোশাক কারখানা শ্রম অসন্তোষের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান ওই এলাকার শিল্প মালিক ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি জানান, “আমার নিজের কারখানাও বন্ধ করে দিতে হয়েছে।”
২০১৮ সালে সর্বশেষ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির প্রায় পাঁচ বছর পর গত আগস্টের ১০ তারিখ নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ৬ মাসের মধ্যে মজুরি ঘোষণার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও মজুরি বোর্ড তা করতে ব্যর্থ হয়। ৬ মাস শেষে গত ২২ অক্টোবর সভায় বিদ্যমান ন্যুনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে শ্রমিকপক্ষ প্রস্তাব দেয় ২০ হাজার ৩৯৪ টাকা।
মালিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার পরদিন থেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শ্রমিকরা। গত সোমবার থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর, কাশিমপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ২৩ হাজার টাকা ন্যুনতম মজুরির দাবিতে কারখানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে।
ডলারের হিসাবে পাঁচ বছর আগের চেয়ে কম মজুরি প্রস্তাব
মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা ২০১৮ সালের চেয়েও কম মজুরির প্রস্তাব বলে অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক নেতা ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন।
বেনারকে তিনি বলেন, “পাঁচ বছর আগে যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়, সমপরিমাণ ডলারের মূল্যে এখন তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ৭০০ টাকা। এর সাথে প্রতি বছর শ্রম আইন অনুযায়ী ৫ শতাংশ মজুরি যুক্ত হলে তা আরো বাড়ে। অথচ মালিকপক্ষ পাঁচ বছর পরেও সেখান থেকে ১ হাজার ৩শ’ টাকা কমাতে চান। এটা যৌক্তিক নয়।”
তিনি বলেন, “এমন প্রস্তাব দিলে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
অবশ্য সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি, শ্রমিকপক্ষও দিয়েছে। এটা তো চূড়ান্ত কিছু নয়।”
“অতীতেও এভাবেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “এর পর আলোচনার ভিত্তিতে একটি মজুরি নির্ধারণ হবে। কিন্তু এ নিয়ে কাজ বন্ধ করে, রাস্তায় নেমে অসন্তোষ করার কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে?”
শ্রমিকদের এভাবে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার পেছনে রাজনৈতিক ’ইন্ধন’ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কার্যকর হবে, তা জানুয়ারির বেতনের সঙ্গে শ্রমিকরা হাতে পাবেন।”
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এর গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘আরএমজি সেক্টর মিনিমাম ওয়েজ: প্রপোজিশন ক্যালকুলেশন অ্যান্ড দ্য রেশনাল’ শীর্ষক এক হিসাবে দেখা গেছে, নয়টি দেশের পোশাক খাতের নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি এখনো বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ৭৫ দশমিক পাঁচ ডলার (বর্তমানে ৭৩)। একই সময়ে চীনে ২৬২ ডলার, ভারতে ১২৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩৭ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১৯৪ ডলার মালয়েশিয়ায় ২৫০ ডলার, ফিলিপাইনে ২৪৪ ডলার, ভিয়েতনামে ১৬৮ ও তুরস্কে ৩০৭ ডলার।
শ্রমিক নেতাদের সহায়তা চেয়েছে বিজিএমইএ
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অসন্তোষ যাতে অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে না পড়ে এবং কারখানাগুলো উৎপাদনে ফিরতে পারে, তার উপায় খুঁজতে শ্রমিক নেতাদের নিয়ে সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন পোশাক খাতের নেতারা।
সভার বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন পোশাক খাতের দুই নেতা তৌহিদুর রহমান ও আমিরুল হক আমিন।
বৈঠক শেষে তৌহিদুর রহমান বেনারকে বলেন, “বিজিএমইএ সভাপতি অসন্তোষ নিরসনে আমাদের সহায়তা চেয়েছেন। তারা বলেছেন, যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা চূড়ান্ত কিছু নয়, এ বিষয়ে আমরা যেন একটি বিবৃতি দিই। কাল (মঙ্গলবার) একটি বিবৃতি আমাদের সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে।”
এর আগে গত রোববার রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রমিক নেতাদের নিয়ে সভা করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। অবশ্য পরদিন অসন্তোষ না কমে উল্টো বেড়েছে।