সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদ্যুতের পর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে শিল্প ও ভোক্তার ওপর
2023.01.18
ঢাকা
বিদ্যুতের দাম বাড়ার এক সপ্তার মধ্যেই বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম।
ছোট-বড়ো শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাণিজ্যিক ভোক্তাসহ কয়েকটি খাতে সর্বোচ্চ প্রায় তিন গুণ পর্যন্ত বাড়া গ্যাসের দাম আগামী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে সরকার।
তবে আবাসিক ব্যবহারকারী, সার কারখানা ও পরিবহনে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি।
শিল্প মালিক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পের ওপর গ্যাসের দাম বাড়া বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যা এসব শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। এর ফলে রপ্তানি আয়ও কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশে ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বেনারকে বলেন, “সরকার যে পদ্ধতিতে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে (নির্বাহী আদেশ) সেটি যৌক্তিক নয়। আমরা জানতে চাই, কেন এবং কী পরিমাণ দাম বাড়ানো উচিত ছিল।”
“এর ফলে কিছুদিন পর বিদ্যুতের মূল্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং পণ্যমূল্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীরা যাতে এই অজুহাতে দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিক না বাড়ায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে,” জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ১২ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতেরও দাম ৫ শতাংশ বাড়ায় সরকার। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে একই প্রক্রিয়ায়।
এদিকে বুধবার রাতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরে একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, “ভর্তুকি সমন্বয় ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য গ্যাসের ট্যারিফ সমন্বয় করা হয়েছে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া এবং অন্যান্য কারণে জ্বালানি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ওই ব্যাখ্যায় বলা হয়, “সামগ্রিকভাবে জ্বালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ... বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি মূল্যও অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি বাবদ প্রদান করতে হচ্ছিল।”
“চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রপ্তানিমুখী বিভিন্ন কলকারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে,” বলা হয় ব্যাখ্যায়।
ভোক্তা পর্যায়েও চাপ বাড়বে
সরকারি হিসেবে, দেশে বর্তমানে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৫০০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট। বাংলাদেশে বর্তমানে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের উৎপাদন প্রায় এক চতুর্থাংশ কম।
বিদেশ থেকে কিছু এলএনজি আমদানিও করেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে বর্ধিত দাম এবং উৎপাদন খরচের তুলনায় বিতরণ মূল্য কম হওয়ায় এ খাতের সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের গ্যাস ভিত্তিক শিল্প কারখানাগুলোর বড়ো অংশই তীব্র গ্যাস স্বল্পতার সংকট ভুগছে, যার কারণে উৎপাদনও কমে গেছে। বিশেষত মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের কিছু অংশ, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহের কিছু এলাকার গ্যাসভিত্তিক শিল্পগুলোতে গ্যাসের প্রেশার কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে।
নিটওয়্যার পোশাক শিল্পের নারায়ণগঞ্জভিত্তিক উদ্যোক্তা মোহাম্মদ হাতেম বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা বলেছিলাম সর্বোচ্চ ২৫ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ালে আমরা দিতে সক্ষম, তাও যদি নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাই। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়তা পাইনি, অথচ দাম বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।”
হাতেম জানান, “এ অবস্থায় শিল্পের লোকসান আরো বাড়বে এবং ভবিষ্যতে শিল্পের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। এতে ভোক্তার উপরও ব্যয়ের চাপ বেড়ে যাবে।”
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সম্প্রতি সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। এতে বলা হয়, বর্তমানে শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পেলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ১৬ টাকার স্থলে ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি আছেন উদ্যোক্তারা।
কিন্তু প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা। সবচেয়ে বেশি হারে দাম বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৫.০২ টাকা, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দিতে হবে ১৪ টাকা।
এ ছাড়া বৃহৎ শিল্পের গ্যাস বিল বাড়বে ১১.৯৮ টাকার স্থলে ৩০ টাকা, মাঝারি শিল্পের ১১.৭৯ টাকার স্থলে ৩০ টাকা, আর ক্ষুদ্র শিল্পে ১০.৮ টাকার স্থলে ৩০ টাকা।
দেশে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের প্রায় ৭৮ শতাংশ ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন, ক্যাপটিভ পাওয়ার ও শিল্পে। বাংলাদেশে টেক্সটাইলের পাশাপাশি নিটওয়্যার শিল্পের ডাইয়িং, ফিনিশিংয়ের জন্যও গ্যাস ব্যবহার হয়।
“গ্যাসের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে, স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ের ব্যয় বাড়বে এবং এর চাপ যাবে ভোক্তার উপর,” বেনারকে বলেন অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ।
তাঁর মতে, গ্যাসের দাম বাড়া “৯ শতাংশের উপর মূল্যস্ফীতির মধ্যে থাকা ভোক্তার উপর নতুন করে চাপ তৈরি করবে। যে সময় আরো বেশি প্রতিযোগিতা সক্ষম হওয়ার চেষ্টা করা দরকার ছিল, সেসময় এর উল্টোটা ঘটল।”